১। চার্বাক শব্দের অর্থ কী ?
উত্তর : ‘চার্বাক’ শব্দের অর্থ বিষয়ে মতভেদ আছে । একটি অর্থে চার্বাক শব্দের অর্থ ভােজনপ্রিয় ও ভােগবিলাসী । কারণ , চার্বাক শব্দটি ‘চব’ ধাতু থেকে পাওয়া , যার অর্থ চর্বন করা বা খাওয়া । অন্য অর্থে চার্বাক শব্দের অর্থ মধুর বাক্য । কারণ ,এটি চারু ও বাক্ শব্দ থেকে পাওয়া । চারু অর্থ মধুর , বাক অর্থ কথা ।
২। চার্বাক দর্শনে উৎস কী ?
উত্তর : চার্বাক দর্শনের উৎপত্তি বিষয়ে মদভেদ আছে । কারও মতে , চার্বাক শব্দটি ‘চর্ব’ ধাতু থেকে এসেছে , যার অর্থ চর্বন করা বা খাওয়া । চার্বাক দার্শনিকগণ ভােজনপ্রিয় ও ভােগবিলাসী ছিলেন বলেই এদের দর্শনকে চার্বাক দর্শন বলা হয় । কারও মতে , চার্বাক শব্দের উৎপত্তি চারু + বাক্ থেকে , চারু শব্দের অর্থ মধুর , বাক শব্দের অর্থ কথা , সুন্দর বা মধুর বাক্য ব্যবহার করায় এই দর্শনকে চার্বাক দর্শন বলা হয় । অন্য একটি মত অনুসারে বৃহস্পতির শিষ্য চার্বাক ঋষি কর্তৃক এই দর্শন প্রচারিত বলেই তার নামানুসারে এই দর্শনকে চার্বাক দর্শন বলা হয় । এছাড়াও আরও একটি মতানুসারে বৃহস্পতির প্রচারিত দর্শনই হল চার্বাক দর্শন । এই জন্য চার্বাক দর্শনের অপর নাম বাৰ্হস্পত্য দর্শন । অবশ্য , বৃহস্পতি বলতে কেউবা দেব গুরু বৃহস্পতির কথা বলেছেন । আর অন্যরা গ্রহরাজ বৃহস্পতিকে চার্বাক দর্শনের প্রবর্তক বলে মনে করেন ।
৩। চার্বাক দর্শনের অন্যান্য নামগুলি কি কি ?
উত্তর : চার্বাক দর্শন বিভিন্ন নামে পরিচিত (১ ) ভারতীয় দর্শনে একমাত্র চার্বাক সম্প্রদায়ই জড়বাদী তত্ত্ব প্রচার করেন । তাই ভারতীয় জড়বাদ বলতে চার্বাক দর্শনকে বােঝায় । ( ২ ) চার্বাক দর্শনে সাধারণ লােকের মতকেই প্রকাশ করা হয়েছে বলে চার্বাক দর্শনের একটি নাম হল — লােকায়ত দর্শন । (৩ ) এই দর্শন বৃহস্পতির প্রচারিত বলে একে বাস্পত্য দর্শনও বলে ।
৪। আদি চার্বাক কারা ?
উত্তর : যে সমস্ত চার্বাকগণ বিতণ্ডায় বিশ্বাসী অর্থাৎ যারা অন্যের মত সমালচনা ও খন্ডন করতেন তারাই আদি চার্বাক । আদি চার্বাকদের বৈতন্ডিক চার্বাকও বলা হয় । এরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ মেনেছেন ।
৫। দেহাত্মবাদ কি ?
উত্তর : দেহাত্মবাদের অর্থ দেহ - ই আত্মা । চৈতন্য বিশিষ্ট দেহকেই যারা আত্মা বলে মানেন তারাই দেহাত্মবাদী এবং তাদের মতই দেহাত্মবাদ ।
৬। ইন্দ্রিয়াত্মবাদ কি ?
উত্তর : যে সমস্ত চার্বাক দার্শনিকগণ ইন্দ্রিয়কে আত্মা বলে স্বীকার করেন তাদের মতই ইন্দ্রিয়াত্মবাদ এবং তারাই ইন্দ্রিয়াত্ববাদীনামে পরিচিত । সুশিক্ষিত চার্বাকদের একটি অংশ মনে করেন আমরা যাকে আত্মা বলি সেটি হল ইন্দ্রিয় । ইন্দ্রিয় দেহেরই একটি অংশ । কারণ , দেহ ব্যতীত ইন্দ্রিয়ের কোন অস্তিত্ব নেই ।
৬। জড়বাদ কি ?
উত্তর : যে মতবাদে চেতনার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে জড়কেই মূল উপাদান বলে মেনেছেন তাদের মতই জড়বাদ । জড়বাদ অনুযায়ী এই জগৎ জড় পরমাণু দ্বারা গঠিত । আমরা যাকে চেতন বলি সেটিও জড় থেকেই সৃষ্ট । ভারতীয় দর্শনে চার্বাকরা জড়বাদী বলে প্রচারিত । কারণ , তারা ক্ষিতি প্রভৃতি জড় ভূত চারটিকেই মূল উপাদান বলে মেনেছেন । এমনকি চৈতন্যও জড়ভূতের সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি আগন্তুক গুণ ।
৭। স্বভাববাদ কি ?
উত্তর : চার্বাক দর্শনের জগৎ সৃষ্টি বিষয়ক ব্যাখ্যাই স্বভাববাদ । কারণ ,চার্বাকরা জগৎ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোন নিমিত্ত কারণ বা স্রষ্টা স্বীকার না করে জড়ভূতের নিজস্ব স্বভাব অনুযায়ী পরমাণুগুলি পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে জগৎ ও জাগতিক বস্তু সৃষ্টি করে ।
৮। চৈতন্য বা চেতনার সৃষ্টিকিভাবে হয় ?
উত্তর : চার্বাক মতে , চেতনা বা চৈতন্য একটি আগন্তুক গুণ, যা ক্ষিতি , অপ , তেজ ও মরুৎ পরমাণুগুলির নির্দিষ্ট পরিমাণ মিশ্রণের ফলে আবির্ভূত হয় । ক্ষিতি , প্রভৃতি পরমাণু চারটি জড় হলেও এদের মিশ্রণের মধ্য দিয়ে চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটে ।
৯। চার্বাক দর্শনের মূল বক্তব্য কি ?
উত্তর : চার্বাক দর্শনের মূল বক্তব্য হল — ( ১ ) এটি সাধারণ মানুষের দর্শন চিন্তার প্রতিফলন অর্থাৎ সুখই জীবনের একমাত্র কাম্য । ( ২ ) স্বর্গ-নরক , ঈশ্বর , পাপ -পুণ্যের কোন অস্তিত্ব নেই । (৩ ) যা কিছু প্রত্যক্ষগ্রাহ্য কেবল তাই সত্য , যার প্রত্যক্ষ হয় না,তা সত্য নয় । ( ৪ ) প্রত্যক্ষ ব্যতীত অনুমান , শব্দ ইত্যাদি প্রমাণ নয় ।
১০। চার্বাক দর্শনের বৈশিষ্ট্যগুলি কি কি ?
উত্তর : চার্বাক দর্শনের বৈশিষ্ট্য হল — (১ ) চার্বাকরাই একমাত্র ভারতীয় জড়বাদী । (২ ) প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ, (৩ ) চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা , দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব নেই , ( ৪ ) মৃত্যুই মুক্তি ( মরণং চ অপবর্গঃ )। ( ৫ ) পরলােক , ঈশ্বর প্রভৃতির কোন অস্তিত্ব নেই । (৬ ) ঈশ্বর রূপে যদি কেউ থাকে তিনি হলেন রাজা । অর্থাৎ রাজাই চার্বাক মতে ঈশ্বর ।
১১। চার্বাকরা পঞ্চম ভূত আকাশ বা ব্যোমকে স্বীকার করে না কেন ?
উত্তর : চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ বলে যার প্রত্যক্ষহয় না তা সত্য নয় । আকাশ বা ব্যোম্ প্রত্যক্ষের বিষয় নয় বলে চার্বাকরা আকাশকে স্বীকার করে না ।