অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর / বার্কলের আত্মগত ভাববাদ ব্যাখ্যা কর ।

Clg philosophy questions answers কলেজ দর্শন প্রশ্নোত্তর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর  বার্কলের আত্মগত ভাববাদ ব্যাখ্যা কর astito protokkho nirvor barkoler atmogoto vabbad bakkha koro


উত্তর : জ্ঞান সম্পৰ্কীয় আলােচনার অন্যতম প্রধান বিষয় হল ‘জ্ঞেয়’ বা যাকে জানা হয় । জ্ঞেয় বিষয়কেই ‘বস্তু’ আখ্যা দেওয়া হয় । এই ‘বস্তু’কে কেন্দ্র করে দর্শনের ইতিহাসে দুটি মতবাদ পাওয়া যায় । যথা — ভাববাদ ও বস্তুবাদ । 

বস্তুবাদ কাকে বলে : বস্তুবাদ মন - নিরপেক্ষ বস্তুর স্বতন্ত্র সত্তার স্বীকৃতি দেয় । এই মতবাদ অনুসারে বস্তুর অস্তিত্ব কারও জানা বা না জানার উপর নির্ভর করে না , অর্থাৎ বস্তু মন , বুদ্ধি বা জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয় । পাশ্চাত্য দর্শনের রাসেল , মুর , লাভজয় , লক্ বস্তুবাদী বলে পরিচিত । 

ভাববাদ কাকে বলে : যে মতবাদে বাহ্যবস্তুর তথা ভৌতবস্তুর বা জড়বস্তুর মন নিরপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না, বরং দাবী করা হয় যে বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব সর্বদাই জ্ঞাননির্ভর বা মননির্ভর অথবা বাহ্যবস্তু স্বরূপত মানসিক বা আধ্যাত্মিক , তাকেই ভাববাদ বলা হয় । বার্কলে, কান্ট, হেগেল প্রভৃতি দার্শনিক ভাববাদী বলে পরিচিত । 

আত্মগত ভাববাদ : আত্মগত ভাববাদ হল সেই মতবাদ যেখানে বলা হয় যে, যে সমস্ত বস্তুধর্ম আমরা প্রত্যক্ষ করি বলে মনে করি , আসলে সেই সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ব জ্ঞাতার মনের উপর নির্ভর করে । এইসব বস্তু বা বস্তুধর্ম হল জ্ঞাতার মন মধ্যস্থ ধর্ম । জড়বস্তু আসলে কতকগুলি সংবেদনের সমষ্টি । দর্শনের ইতিহাসে এ্যানাস ক্যাগােরাসের মতবাদে ভাববাদের সূত্রপাত দেখা গেলেও আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে বার্কলেকেই ভাববাদের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় । 

বার্কলের মত : বার্কলে বলেন , সমস্ত পদার্থকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় — মন ও তার ধারণা । বার্কলের দর্শনের মূল বক্তব্য হল অনুভব ছাড়া কোনও বস্তুর জ্ঞান হয় না । এর জন্য সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ব অনুভবের বা  চেতনার উপর নির্ভরশীল । 


গুণের শ্রেণিবিভাগ : জন লক্ - এর দার্শনিক মতবাদের সূত্র ধরে বার্কলে তার আত্মগত ভাববাদ প্রতিষ্ঠা করেন । লকের মতে দ্রব্য হল কতকগুলি গুণের সমষ্টি । তাদের মধ্যে কতকগুলি হল মুখ্য গুণ, যেগুলি দ্রব্যের মধ্যেই থাকে , যাদের মননিরপেক্ষ সত্তা রয়েছে । আর কতকগুলি হল গৌণ গুণ , যেগুলির অস্তিত্ব দ্রব্যে নয় — আমাদের মনে । লক্ আরও বলেন , আমরা সােজাসুজি যা জানি তা হল আমাদের মনের ধারণা । আর জ্ঞেয় বস্তুকে আমরা জানি পরােক্ষভাবে ধারণার মাধ্যমে । 

বার্কলের আরও যুক্তি : বার্কলে আরও বলেন আমরা যদি সােজাসুজি মনের ধারণাকেই জানতে পারি তাহলে ধারণার অন্তরালে তার আশ্রয় হিসাবে কোন বস্তু আছে এমন কথা বলার কোন যুক্তিসংগত কারণ নাই । আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তা আমাদের মনের ধারণা এবং মন । সুতরাং , মন এবং ধারণার বাইরে কোনও বস্তুকে স্বীকার করা নিষ্প্রয়ােজন । জড় দ্রব্যের কোনও অস্তিত্ব নেই । 

বার্কলের সিদ্ধান্ত : এই তত্ত্ব থেকে বার্কলে সিদ্ধান্তে এলেন — সত্তা হল জ্ঞাততা ( Esse est percipi to be is to be percipi ) । যা জ্ঞাত বা অনুভূত তাই অস্তিত্বশীল আর যা জ্ঞাত নয় তার কোন অস্তিত্ব নেই । বিশ্বব্ৰত্মাণ্ডে সব সৎ এই অর্থে যে , এই সবের জ্ঞাততা ধর্ম বর্তমান । আমাদের মন ধারণাকে প্রত্যক্ষ করে । 

জড়দ্রব্যের অস্তিত্ব খণ্ডন : বার্কলে জড়দ্রব্যের অস্তিত্ব খণ্ডন করেছেন । তার মতে দ্রব্য প্রত্যক্ষের বিষয় নয় । এবং যা প্রত্যক্ষের বিষয় নয় তার কোনও অস্তিত্বথাকতে পারে না । এই প্রসঙ্গে বার্কলে মুখ্য গুণ খণ্ডন করেছেন কতকগুলি যুক্তির সাহায্যে – 

( i ) মুখ্য গুণ যেমন বিস্তৃতি, গতি , ঘনত্ব , স্থিরতা প্রভৃতি আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করি । যা প্রত্যক্ষ করা হয় তা মনের ধারণা । সুতরাং এইগুলিও গৌণ গুণগুলির মতাে মন - নির্ভর । 

( ii ) উভয়কে পৃথকভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় না । কোন কিছুর বিস্তৃতি প্রত্যক্ষ করার সময় রঙটিও প্রত্যক্ষ করা হয় । সুতরাং রঙ মনের ধারণা হলে বিস্তৃতিও মনের ধারণা । 

( iii ) গৌণ গুণগুলি এক এক জনের কাছে এক এক রকম । মুখ্য গুণগুলিও তাই । একই খাদ্য কারও কাছে সুস্বাদু আবার কারও কাছে বিস্বাদ লাগে । একই বস্তু কারও কাছে ভারী , অন্যের কাছে হালকা মনে হতে পারে । এইভাবে বার্কলে দেখাতে চাইলেন বস্তুহল কতকগুলি গুণের সমষ্টি । 


 এই প্রসঙ্গে ড . জনসন একটি পাথরের গায়ে লাথি মেরে বােঝাতে চেয়েছিলেন , এইভাবে আমি একে ( বার্কলের মতবাদ ) খণ্ডন করছি । আবার এর বিরুদ্ধে বার্কলেও দেখাতে পারেন যে , জনসন যাকে পাথর বলে প্রত্যক্ষ করলেন তা কতগুলি স্পর্শগত ও পেশীগত সংবেদন । 
 

ঈশ্বরের উপস্থিতি : বার্কলে তার পরবর্তী রচনায় ঈশ্বরের ধারণার সাহায্যে বস্তুর অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন । তিনি বলেন , আমরা যখন কোন বস্তু প্রত্যক্ষ করি না তখন তা ঈশ্বরের ধারণারূপে থাকে । এই পরম চেতন সত্তা নিয়মিত পারম্পর্য অনুসারে আমাদের সংযােজনের ধারণাগুলিকে মনে উৎপন্ন করে । এবং এইগুলি হল প্রাকৃতিক নিয়ম । 

সমালােচনা : ( i ) বার্কলের মতবাদের বিরুদ্ধে বলা যায় যে , তাঁকে কখনই বস্তুগত ভাববাদী বলা যায় না । কারণ বার্কলে কখনই বলেন নি যে , ঈশ্বরের আত্মপ্রকাশের জন্য জগতের প্রয়ােজন বা ঈশ্বর জগতের মাধ্যমে নিজেকে উপলব্ধি করেছেন বা জগৎ ঈশ্বরের বাস্তব রূপ । বরং হেগেলকে বস্তুগত ভাববাদী বলা যেতে পারে । কারণ হেগেলের মতে , জগৎ ঈশ্বরের মনের ধারণা মাত্র নয় , বাস্তব রূপও বটে । 
 
( ii ) হিউমের মতে বার্কলের আত্মগত ভাববাদের পরিণাম হল — আত্মকেন্দ্রিকতাবাদ । তবে হিউমও ‘যথার্থ’ নন । কারণ বার্কলে ‘আমি’ ও ‘আমার’ ধারণা ছাড়া অন্যান্য জীবাত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন । 

( iii ) বার্কলের বিরুদ্ধে মুর এবং পেরী বলেন — যে তথ্য ( অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর )-এর উপর বার্কলের মত প্রতিষ্ঠিত তা যথাযথ নয় । বস্তু আছে বলেই আমরা তাকে প্রত্যক্ষ করি । 

( iv ) বস্তুর সংবেদন এবং বস্তুর জ্ঞান ভিন্ন না হলে সব ক্ষেত্রেই আমাদের জ্ঞান একরকম হত । আলেকজাণ্ডারের মতে — কোন কিছুর জ্ঞানের জন্য মনের উপর নির্ভর করতে হয় সত্য , কিন্তু অস্তিত্বের জন্য নয় । 


সিদ্ধান্ত : উপরের আলােচনা ও সমালােচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় - বার্কলের ভাববাদ একটি ত্রুটিপূর্ণ তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত । যা তিনি পূর্ব থেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন ,কিন্তু প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নি । আবার বস্তুর ধারাবাহিকতা ও স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে তিনি টেনে এনেছেন । যার ফলে বার্কলের মতবাদ না হয়েছে আত্মগত , না হয়েছে বস্তুগত । আবার না হয়েছে জ্ঞানত্ত্বমূলক , না হয়েছে অধিবিদ্যামূলক । 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন