১। বৈশেষিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে ?
উত্তর : বৈশেষিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি কণাদ । কণাদের অপর নাম ‘কণভক্ষ’ তন্ডুল কণা সংগ্রহ করে আহার করতেন বলেই তার এরূপ নাম । এছাড়া , তার প্রকৃত নাম উলুক । এই কারণে রচিত বৈশেষিক দর্শন ‘ঔলুক্য দর্শন’ নামেও তার পরিচিত ।
২। বৈশেষিক দর্শনে উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি কি কি ?
উত্তর : বৈশেষিক দর্শনের মূল গ্রন্থ হল মহর্ষি কণাদ বিরচিত বৈশেষিক -সূত্র , পরবর্তীকালে বৈশেষিক সূত্রের উপর রচিত প্রশস্তপাদের ‘পদার্থধর্মসংগ্রহ’ । এটি ভাষ্য গ্রন্থ বলে এই গ্রন্থটি প্রশস্তপাদভাষ্য নামেও পরিচিত । এটি বৈশেষিক সুত্রের প্রাচীনতম ভাষ্য গ্রন্থ । পরবর্তীকালে ‘কারণভাষ্য’ এবং ‘ভারদ্বাজভাষ্য’ নামে বৈশেষিক সূত্রের উপর আরও দুটি ভাষ্য রচিত হয় । এছাড়াও উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি হল , শঙ্কর মিশ্রের উপস্কার টীকা ও কণাদরহস্য , বল্লভাচার্যের লীলাবতী , শঙ্কর মিশ্রের লীলাবতী কণ্ঠাভরণ , ব্যোমশিবাচার্যের ব্যোমবতী , শ্রীধরের ন্যায়কন্দলী , উদয়নের কিরণাবলী , জগদিশের তর্কামৃত ও পদার্থতত্ত্ব নির্ণয় , রঘুনাথের পদার্থতত্ত্ব নিরুপণ ইত্যাদি ।
৩। পদার্থ কি ?
উত্তর : পদার্থ হল ‘পদ + অর্থ’ অথবা ‘পদস্য অর্থঃ পদার্থঃ’ - কাজেই , পদার্থ বলতে পদের অর্থকেই বােঝায় । কোন একটি পদের দ্বারা যে অর্থ বা বিষয় নির্দেশিত হয় সেই বিষয়টি পদার্থ । যেমন — ‘ঘট’ – এই পদটি বিশেষ এক ধরণের বস্তুকে নির্দেশ করে বলে ওই বিশেষ বস্তুটি হল ‘ঘট’ পদের অর্থ বা পদার্থ ।
৪। পদার্থ কয় প্রকার ও কি কি ?
উত্তর : বৈশেষিক দর্শনে ভাব এবং অভাব নামে দু প্রকার পদার্থ স্বীকার করা হয়েছে । ভাব পদার্থ আবার ছয়টি । যথা — দ্রব্য , গুণ , কর্ম , সামান্য , সমবায় , বিশেষ । কাজেই , মােট পদার্থ হল সাতটি । অভাব পদার্থ বলতে যেকোনাে ভাবপদার্থের অনস্তিত্বই অভাব ।
৫। দ্রব্য কি ?
উত্তর : দ্রব্য হল বৈশেষিক স্বীকৃত প্রথম পদার্থ । দ্রব্যের লক্ষণ করা হয়েছে “ ক্রিয়াগুণবৎ সম্বন্ধে সমবায়ীকারণং ইতি দ্রব্যলক্ষণ”—অর্থাৎ গুণ ও কর্ম যাতে সমবায় সমবায় সম্বন্ধে থাকে তাই দ্রব্য । সমবায় সম্বন্ধে অর্থ গুণ ও কর্ম কখনও দ্রব্যকে ছেড়ে থাকে না । এদুটি দ্রব্যাশ্রয়ী অর্থাৎ দ্রব্যকে আশ্রয় করেই থাকে ।
৬। দ্রব্য কয় প্রকার ও কি কি ?
উত্তর : বৈশেষিক মতে দ্রব্য নয়টি — ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ , বােম , দিক , কাল , আত্মা , ও মন । এর মধ্যে ক্ষিতি, অপ , তেজ , মরুৎ , ও ব্যোমকে পঞ্চভূত বলা হয় ।
৭। গুণ কি ?
উত্তর : বৈশেষিক দর্শনে গুণের লক্ষণ করা হয়েছে , “দ্রব্যায্যা গুণবান সংযােগবিভাগেন্থকারণমপেক্ষ ইতি গুণলক্ষণ” — অর্থাৎ যা দ্রব্যাশ্রয়ী অগুণবান এবং সংযােগ ও বিভাগের প্রতি নিরপেক্ষ কারণ নয় তাই গুণের লক্ষণ । অন্নংভট ‘তর্কসংগহহ’ গ্রন্থে বলেছেন , ‘দ্রব্য কর্ম ভিন্নত্বে সতি সামান্যবান গুণঃ’ — অর্থাৎ দ্রব্য ও কর্ম ভিন্ন যে পদার্থ সামান্যবান তাই গুণ ।
৮। গুণ কয়টি ও কি কি ?
উত্তর : বৈশেষিক মতে , গুণ ২৪ টি । যথা— রূপ , রস , গন্ধ , স্পর্শ , সংখ্যা , পরিমাণ , পৃথকত্ব সংযােগ , বিভাগ , পরত্ব , অপরত্ব , জ্ঞান , সুখ , দুঃখ , ইচ্ছা , দ্বেষ , প্রযত্ন — এই ১৭ টি গুণের কথা মহর্ষি কণাদ নিজেই বলেছেন । এছাড়া , গুরুত্ব , দ্রব্যত্ব , স্নেহ , সংস্কার , অদৃষ্ট অর্থাৎ ধর্ম ও অধর্ম , এবং শব্দ ।
৯। সামান্য কয় প্রকার ও কি কি ?
উত্তর : সামান্য দু’প্রকার — পর সামান্য এবং অপর সামান্য । আচার্য প্রশস্তপাদ তার ভাষ্যে কণাদের বৈশেষিক - সূত্র অনুসরণে এই দুটি সামান্যের কথাই বলেছেন । পরবর্তীকালে সামান্য - বিশেষ নামে আর একটি সামান্য স্বীকার করা হয় । পরবর্তী বৈশেষিকগণ সামান্যের তিনটি বিভাগ মেনেছেন । যথা — পর সামান্য , অপর সামান্য এবং পারপর সামান্য ।
১০। পর ও অপর সামান্যের মধ্যে প্রভেদ কি ?
উত্তর : যে সামান্যের ব্যাপকতা এতই বেশি যে সবকিছুকেই নিজের অন্তর্ভুক্ত সেই সামান্যই পরসামান্য । যেমন — সত্তা । আর যে সামান্যের ব্যাপকতা এতই কম যে সামান্য সে কেবলমাত্র নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাকে সেই সামান্যই অপর সামান্যই । যেমন - ঘটত্ব ।
১১। মহর্ষি কণাদ রচিত দর্শনের নাম বৈশেষিক দর্শন কেন ?
উত্তর : মহর্ষি কণাদ দর্শন আলােচনায় ‘বিশেষ’ নামে একটি অতিরিক্ত পদার্থ স্বীকার করে তার বিস্তারিত আলােচনা করায় তার রচিত দর্শনকে বৈশেষিক দর্শন বলা হয় ।
১২। দ্রব্যের প্রত্যক্ষ কি সম্ভব ?
উত্তর : বৈশেষিক স্বীকৃত নয়টি দ্রব্যের মধ্যে আকাশ , দিক , কাল , ও মনের প্রত্যক্ষ হয় না । কারণ আকাশ ও দিক অতীন্দ্রিয় হওয়ায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় । পূর্ব-পশ্চিম , উত্তর - দক্ষিণ ইত্যাদি ব্যবহারের হল দিকের ব্যবহার । দিকের মতাে কালকেও প্রত্যক্ষ করা যায় না । আবার , মন অনুপরিমাণ বলে তারও প্রত্যক্ষ সম্ভব নয় ।
১৩। পরমাণুকে কিভাবে জানা যায় ?
উত্তর : পরমাণু প্রত্যক্ষের বিষয় নয় বলে অনুমানের সাহায্যে পরমাণুকে জানতে হয় । যে কোন সাবয়ব দ্রব্যকে ক্রমাগত বিভাজন করলে অবশেষে এমন একটি ক্ষুদ্রতম কণা বা অংশকে পাওয়া যাবে যেটি অংশহীন বা নিরংশ । এই ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য অংশই পরমাণু । কাজেই , অনুমানের সাহায্যেই পরমাণুকে জানতে হয় ।