ভারতীয় দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য

Clg philosophy questions answers কলেজ দর্শন অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর ভারতীয় দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য bharatiyo dorshoner sadharon boishishto

১ । ‘দর্শন’ শব্দের অর্থ কী ?

উত্তর -  ‘দর্শন’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল দেখা । কারণ , ‘দর্শন’ শব্দটি ‘দৃশ’ ধাতুর অনট প্রত্যয় যােগে নিষ্পন্ন । ‘দৃশ’ ধাতুর অর্থ দেখা । যদিও ভারতীয় দর্শনে দেখা বলতে তত্ত্বদর্শন বা সত্যের উপলব্দিকেই বােঝায় । কাজেই , দর্শন শব্দের অর্থ তত্ত্বের সাক্ষাৎ উপলব্ধি বা তত্ত্বদর্শন । 


২। ভারতীয় দর্শনের স্রষ্টা কারা ? 

উত্তর : ভারতীয় দর্শনের স্রষ্টা হলেন প্রাচীন আর্য  মুনিঋষিগণ । প্রাচীন মুনি ঋষিগণ ধ্যানমগ্ন অবস্থায় যে সমস্ত তত্ত্ব সাক্ষাৎ করতেন বা তত্ত্বের উপলব্ধি করতেন সেগুলিই পরবর্তীকালে তাদের শিষ্যবর্গের কাছে আলােচনা করতেন এবং বেদের তত্ত্ব শিক্ষা দিতেন । এই সমস্ত আলােচনাই ভারতীয় দর্শন ।


৩। পরম পুরুষাৰ্থ কী ? পরম পুরুষার্থ কোনটি ও কেন ? 

উত্তর : পরম পুরুষার্থ হল পরম কাম্য বস্তু । ধর্ম,অর্থ, কাম এবং মােক্ষ এই চারটির মধ্যে মােক্ষকে পরম পুরুষার্থ বলা হয় । কারণ , মােক্ষলাভের পর জীবের আর কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার থাকে না । 


৪। কর্মবাদ কী ?


উত্তর : কর্মবাদ হল কর্মনিয়ম , প্রতিটি জীব যে কর্ম করে সেই কর্ম অনুযায়ী জীবকে ফল ভােগ করতে হয় । কর্ম , কর্মফল এবং কর্মফলভােগের যে সম্বন্ধ তাই কর্মনিয়ম । জীব তার কর্ম অনুযায়ী ফল ভােগ করে এই মতবাদই কর্মবাদ । 

৫। মােক্ষ কি ? 

উত্তর : মােক্ষ একটি আনন্দময় অবস্থা । যে অবস্থায় পৌছানাের পর জীবকে আর জন্মগ্রহণ করতে হয় না । 


৬। মােক্ষ লাভের উপায় বা পথ কি ? 

উত্তর : ভারতীয় দর্শনে মােক্ষলাভের উপায় বা পথকে মার্গ বলা হয় । মার্গ তিনটি — কর্মমার্গ, ভক্তিমার্গ এবং জ্ঞানমার্গ । কর্মমার্গ হল নিষ্কাম কর্ম দ্বারা মােক্ষ লাভ , যা গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন । ভক্তিমার্গ হল নিজেকে ভক্ত হিসাবে ভগবানের কাছে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করা । জ্ঞানমার্গ হল তত্ত্ব জ্ঞান লাভের মাধ্যমে মােক্ষলাভ ( জ্ঞানমুক্তি) ।


৭। ধর্ম বলতে কী বােঝায় ? 

উত্তর : ‘ধর্ম’  কথাটি সংস্কৃত ‘ধৃ’ ধাতুর সাথে মন্ প্রত্যয় করে পাওয়া । ‘ধৃ’ ধাতুর অর্থ ধারণ করা । যা সবকিছুকে ধারণ করে রাখে তাই ধর্ম । এটিকে ভারতীয় দর্শনে একটি গৌণ পুরুষার্থ বলা হয়েছে । 

৮।  অর্থ কী ? 

উত্তর : ভারতীয় দর্শন অনুসারে অর্থ হল একটি গৌণ পুরুষার্থ । অর্থ দ্বারা সাক্ষাৎভাবে সুখ অনুভূত হয় না । সুখকর বা কাম্য বস্তু লাভের ক্ষেত্রে অর্থ বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে । 


৯। কাম কী ? 

উত্তর : ‘কাম ’ কথাটি কামনা থেকে এসেছে । যা কিছু কামনা করা হয় তাই কাম । ভারতীয় দর্শনে ‘ কাম’কে একটি পুরুষার্থ বলা হয়েছ । কাম দ্বারা সরাসরি ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্ত হয় । কাম বলতে এক প্রকার জৈবিক প্রবৃত্তিকেও বােঝায় । কাম দ্বারা জৈবিক বৃত্তির নিবৃত্তি হলেও তা সাময়িক , স্থায়ী নয় বলে এটিও গৌণ পুরুষার্থ ।



১০। প্রমাণ কি ? 

উত্তর : প্ৰমার করণকেই প্রমাণ বলে ( প্রমাকরণং প্রমাণম ) । অর্থাৎ যার দ্বারা প্রমা বা যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় তাই প্রমাণ । ‘করণ’ বলতে অসাধারণ কারণকে যেমন বােঝায় তেমনি ব্যাপার বিশিষ্ট কারণকেও করণ বলে । কাজেই , কার্যের অব্যবহিত পূর্বে যে ব্যাপারটি উপস্থিত হয়ে কার্যকে উৎপন্ন করে তাই করণ । যথার্থ জ্ঞানলাভের উপায়কেই প্রমাণ বলে । 


১১। অপ্রমা কয় প্রকার ও কি কি ? 

উত্তর : অপ্রমা তিন প্রকার । যথা — সংশয় , বিপর্যয় এবং তর্ক । এই তিনটি ছাড়া স্মৃতিকেও ন্যায়দর্শনে অপ্রমা হয়েছে । কারণ , স্মৃতি যথার্থ অযথার্থ যাই হােক না কেন  বলা বা স্মৃতি অনুভব নয় । কাজেই , অপ্রমা হল অযথার্থ অনুভবাত্মক জ্ঞান। 


১২।  বেদ কয়টি ও কি কি ? 

উত্তর : ‘বেদ ’ কথাটির অর্থ জ্ঞান । কাজেই জ্ঞানের বিভাগ সম্ভব নয় বলে বেদেরও বিভাগ সম্ভব নয় । তৎ সত্ত্বেও বেদের বিভিন্ন বিষয়ের আলােচনার ভিত্তিতে বেদকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয় । এই চারটি বেদ হল — ঋক , সাম ,যজুঃ এবং অথর্ব । 

১৩। বেদাঙ্গ বলতে কি বােঝায় ? 

উত্তর : বেদাঙ্গ বলতে বােঝায় বেদের অঙ্গকে । বেদের শব্দ ও অর্থবােধের প্রয়ােজনে সৃষ্ট বেদের অঙ্গ ছয়টিকেই বেদাঙ্গ বলা হয় । এই ছয়টি বেদাঙ্গ হল — শিক্ষা , কল্প , নিরুক্ত , ছন্দ , জ্যোতিষ এবং ব্যাকরণ । 


১৪। বেদান্ত কী ? 

উত্তর : বেদান্ত হল বেদের অন্ত বা শেষ । বেদের শেষ অংশে আলােচিত উপনিষদকেই বেদান্ত বলা হয় । ‘অন্ত’ শব্দের অন্য একটি অর্থ হল শ্রেষ্ঠ । বেদের শ্রেষ্ঠ অংশই বেদান্ত । বেদের শ্রেষ্ঠ অংশে বেদের তত্ত্বই আলােচিত হয়েছে । তাই , বেদের শ্রেষ্ঠ অংশ বা উপনিষদকেই বেদান্ত বলা হয় । 


১৫। ‘উপনিষদ’ শব্দের অর্থ কী ? 

উত্তর : বুৎপত্তিগত অর্থে উপনিষদ হল উপ - নিষদ্ + ক্লিপ প্রত্যয়, যার অর্থ গুরুর সমীপে উপবিষ্ট হয়ে গুরুর কাছ থেকে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করা । 


১৬। উপনিষদ কয়টি ও কি কি ? 

উত্তর : উপনিষদের সংখ্যা মােটামুটিভাবে ১০৮ টি। যদিও বর্তমানে কেবলমাত্র ১৮ টি উপনিষদকেই উল্লেখযােগ্য বলে মনে করা হয় । এইগুলি যথাক্রমে — ঈশ , কেন , ছান্দোগ্য বৃহদারণ্যক , ঐতরেয় , তৈত্তিরীয় , কৌষীতকি কঠ , মুণ্ডক , মান্ডুক্য, এবং শ্বেতাশ্বতর ।



১৭। সূত্র কী ? 

উত্তর : ‘সূত্র’ অর্থ সূত , যা একই সাথে অনেক বিষয়কে ধরে রাখে । বেদের বিভিন্ন তত্ত্ব সমূহকে অতি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার সময় যে বিশেষ অর্থপূর্ণ বাক্য ব্যবহার করা হয় তাই সূত্র। 


১৮। ভাষ্য কী ? 

উত্তর : অনেকগুলি তত্ত্ব অতি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার ফলে সূত্রের প্রকৃত অর্থ সব সময় বােধগম্য হয় না । এজন্য সূত্রের অর্থকে পরিস্ফুট ও বােধগম্য করার জন্য সুত্রাথের যে বিস্তৃতকরন তাই ভাষ্য ।



১৯। ভারতীয় দর্শন কি দুঃখবাদী ?

 উত্তর : ভারতীয় দর্শনে বিশেষতঃ বৌদ্ধদর্শনে মানবজীবনকে দুঃখময় বলে বর্ণনা করায় অনেকে ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধ দুঃখবাদের অভিযােগ করেন । কিন্তু ভারতীয় দর্শন দুঃখবাদী নয় , আশাবাদী । কারণ ,ভারতীয় দর্শনে দুঃখ নিবৃত্তির পথ নির্দেশও আছে , বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখের চিরনিবৃত্তির মাধ্যমে নির্বাণ লাভের কথা বলা হয়েছে । 
 
২০। ঋণ কি ? ঋণ কয় প্রকার ও কি কি ? 

উত্তর : ঋণ বলতে বােঝায় কারও কাছ থেকে কোনাে সাহায্য নেওয়া । ঋণ পাঁচ প্রকার দেবঋণ , পিতৃঋণ , ঋষিঋণ , ভূতঋণ এবং নৃঋণ । 



২১। আস্তিক শব্দের অর্থ কী ? আস্তিক দর্শন কাকে বলে ? 

উত্তর : আস্তিক শব্দের অর্থ ঈশ্বরে বিশ্বাস । যদিও ভারতীয় দর্শনে আস্তিক শব্দের অর্থ করা হয়েছে বেদের প্রামাণ্য বিশ্বাস । যে ভারতীয় দর্শন বেদকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং বেদের তত্ত্বকে অভ্রান্ত বলে স্বীকার করে সেই দর্শনই আস্তিক দর্শন । ভারতীয় দর্শন বেদকে অভ্রান্ত বলে মনে করায় ভারতীয় দর্শনকে আস্তিক দর্শন বলা হয় । 

২২। নাস্তিক শব্দের অর্থ কী ? নাস্তিক দর্শন কাকে বলে ? 


উত্তর : নাস্তিক শব্দের অর্থ ঈশ্বরে অবিশ্বাস হলেও ভারতীয় দর্শনে নাস্তিক বলতে বেদের প্রামাণ্যকে অস্বীকার করাকে বােঝায় । যে ভারতীয় দর্শনে বেদের প্রামাণ্যকে স্বীকার করা হয়নি এবং যে দর্শনে বেদের বিরােধিতা করা হয়েছে তাই নাস্তিক দর্শন । 


২৩। নাস্তিক সম্প্রদায়গুলি কি কি ? 

উত্তর : ভারতীয় দর্শনের নাস্তিক সম্প্রদায় তিনটি – চার্বাক, বৌদ্ধ এবং জৈন । 


২৪। অস্তিক সম্প্রদায় কয়টি ও কি কি ? 

উত্তর : ভারতীয় দর্শনের আস্তিক সম্প্রদায় ছয়টি । যথা – ন্যায়, বৈশেষিক , সাংখ্য , যােগ , বেদান্ত এবং মীমাংসা ।



২৫। ষড়দর্শন কী ? 

উত্তর : যড়দর্শন বলতে ছয়টি আস্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত দর্শনকেই বােঝায় । ছয়টি আস্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত দর্শনকে একত্রে যড়দর্শন বলে । 


২৬। ভারতীয় দর্শনের মােট সম্প্রদায় কয়টি ও কি কি ? 

উত্তর : ভারতীয় দর্শনের মােট সম্প্রদায়ে নয়টি । যথা— চার্বাক , বৌদ্ধ , জৈন , ন্যায় , বৈশেষিক , সাংখ্য , যােগ , মীমাংসা এবং বেদান্ত । এই নয়টি সম্প্রদায়ই ভারতীয় দর্শন ।


২৭। বৈদিক দর্শন কাকে বলে ? উদাহরণ দাও । 

উত্তর : যে সমস্ত দর্শন বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত অথবা বেদকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে তাই বৈদিক দর্শন । যেমন – ন্যায়, বৈশেষিক , সাংখ্য , যােগ , মীমাংসা এবং বেদান্ত । 


২৭। অবৈদিক দর্শন কাকে বলে ? উদাহরণ দাও । 

উত্তর : যে দর্শন বেদের প্রমাণ্য অস্বীকার করে অথবা বেদের বিরােধিতা করতে গিয়ে গড়ে উঠেছে সেই দর্শনই অবৈদিক দর্শন । যেমন —চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন ।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন