উত্তর : বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদ বা প্রতীকবাদ বস্তুর মন -নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করে । কিন্তু এই মতানুসারে বস্তুর জ্ঞান আমরা লাভ করি পরােক্ষভাবে কোন ধারণা বা প্রতীকের মাধ্যমে । দার্শনিক লক্ বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদের প্রবর্তন করলেন , যা সরল বস্তুবাদের অনেক দোষত্রুটি থেকে মুক্ত । সরল বস্তুবাদ ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের কোন যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পারেনি । দার্শনিক লক্ সেই ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হলেন । সবিচার বা বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদ লৌকিক বস্তুবাদের মতােই মন ও জ্ঞানাতিরিক্ত বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকার করে । কিন্তু যেভাবে এই বাহ্য বস্তুগুলি আমাদের কাছে আবির্ভূত হয় ,বাহ্যবস্তুগুলি আসলে যা , তার থেকে স্বতন্ত্রভাবেই তাদের আবির্ভাব হয়ে থাকে । দৈনন্দিন জীবনে আমরা দেখি যে একটি বৃক্ষের আকার , আকৃতি , ওজন , বর্ণ , কাঠিন্য ইত্যাদি আছে । কিন্তু লক্ - এর মতানুসারে এই গুণগুলি সবই এক ধরনের নয় । তিনি গুণগুলিকে দু’শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন — মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণ । কাজেই এ মতবাদ বস্তুর মুখ্য ও গৌণ গুণের মধ্যে প্রকারভেদ স্বীকার করে ।
লকের মতে বস্তু হচ্ছে কতকগুলি গুণের সমষ্টি ।তিনি বস্তুর গুণগুলিকে দু’শ্রেণিতে ভাগ করেছেন , যেমন — মৌলিক বা মুখ্য গুণ Praimary quality এবং গৌণ গুণ ( Secondary quality ) । মুখ্য গুণগুলাে বস্তুগত অর্থাৎ এই গুণগুলাের প্রকৃত অস্তিত্ব আছে । ব্যক্তিজ্ঞানের ওপর এই গুণগুলাের অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয় । লকের মতে মুখ্য গুণগুলাে দেশকে আশ্রয় করে থাকে । বস্তুর রূপ , রস গন্ধ , শব্দ , স্পর্শ প্রভৃতি গুণ হল গৌণ গুণ । বস্তুর মুখ্য গুণগুলাে ( যেমন — বিস্তৃতি , আয়তন , আকার , সংখ্যা ইত্যাদি ) সকল ব্যক্তির নিকট একই রকম বলে মনে হয় বলে এগুলাে বস্তুগত এবং অপরিবর্তনশীল । কিন্তু গৌণ গুণগুলি ( যেমন — বর্ণ , স্বাদ , গন্ধ ইত্যাদি ) বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট ভিন্ন ভিন্ন বলে মনে হয় বলে এগুলাে ব্যক্তিগত এবং পরিবর্তনশীল । লক্ মুখ্য গুণের আধাররূপে দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন । কিন্তু আমাদের মন সােজাসুজিভাবে কেবলমাত্র গুণগুলিকে জানতে পারে । লকের মতে দ্রব্য হল অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় ।
এই মতবাদ সবিচার বস্তুবাদ নামেও পরিচিত : এই মতবাদকে বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ বলা হয় । যেহেতু সেই সময়কার বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় প্রভাব এই মতবাদের উপর পড়েছিল । লক্ বস্তুর সকল গুণকে যে দুটি ভাগে শ্রেণিবিভক্ত করেছিলেন , মুখ্য এবং গৌণ গুণ তাও তৎকালীন বৈজ্ঞানিকদের স্বীকৃতি লাভ করেছে । বিচারের উপর এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত বলেই একে সবিচার বস্তুবাদ বলা হয় ।
এই মতবাদ প্রতীকবাদ নামেও পরিচিত : যেহেতু প্রতীকের মাধ্যমেই বস্তুর জ্ঞান হয় তাই এই মতবাদ প্রতীকবাদ নামে পরিচিত । দার্শনিক ডেকার্ত এবং লকের মতে আমাদের মন সােজাসুজি কোন বস্তু জানতে পারে না । মন সাক্ষাৎভাবে কেবলমাত্র তার ধারণাগুলিকেই জানতে পারে , চেতনা হল একটা পর্দা যেখানে বাহ্যবস্তুর প্রতিলিপিগুলি ধারণারূপে প্রতিবিম্বিত হয় । বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে , কিন্তু আমরা তাকে ধারণা বা প্রতীকের মাধ্যমে পরােক্ষভাবে জানি । ধারণাই আমাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয় । লকের মতে ধারণার সঙ্গে বাহ্যবস্তুর যদি মিল থাকে তাহলে জ্ঞান যথার্থ হয় ; আর যদি মিল না থাকে তা হলে জ্ঞান হয় ভ্রান্ত ।
সরল বস্তুবাদ ভ্রান্ত জ্ঞানের কোন ব্যাখ্যা দিতে পারে না । লকের মতবাদের সুবিধা হল এই যে , বস্তুর অস্তিত্ব ছাড়াও মনের ধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়াতে , এই মতবাদ সহজেই ভ্রান্ত জ্ঞানের ব্যাখ্যা দিতে পারে । যখন আমরা দড়িকে সাপ দেখি , তখন প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের মনের ধারণাকে প্রত্যক্ষ করি ।
সমালােচনা : সবিচার বা বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদ ভ্রান্ত জ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারলেও , এই মতবাদের নানাপ্রকার সমালােচনা করা হয়েছে ।
প্রথমত । বাহ্যজগতের মন - নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার করলেও লক্ বাহ্যজগতের অস্তিত্বের যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি , কারণ তাঁর মতে দ্রব্য বা বস্তু হল অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় ।
দ্বিতীয়ত । লক্ বলেছেন , মনের ধারণার সঙ্গে যদি বাহ্যবস্তুর সাদৃশ্য থাকে তাহলে জ্ঞান হবে সত্য , আর বাহ্যবস্তুর সঙ্গে যদি মনের মনের ধারণার সাদৃশ্য না থাকে তাহলে জ্ঞান হবে মিথ্যা । কিন্তু যেহেতু বাহ্যবস্তু অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় , সেহেতু আমাদের মনের ধারণার সঙ্গে বাহ্যবস্তুর সাদৃশ্য আছে কিনা তা জানা সম্ভব নয় ।
তৃতীয়ত । লকের মতে মন প্রত্যক্ষভাবে কেবলমাত্র ধারণাগুলােকে জানতে পারে । বস্তু বা দ্রব্যকে কখনও সােজাসুজিভাবে জানা যায় না । বার্কলে বলেন , যাকে সােজাসুজিভাবে জানা যায় না , তার অস্তিত্ব স্বীকার করা যুক্তিযুক্ত নয় । যেহেতু আমরা ধারণাগুলাের সাক্ষাৎ জ্ঞান লাভ করি , সেহেতু বার্কলে কেবলমাত্র ধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন । ফলে লকের বস্তুবাদ আত্মগত ভাববাদে পরিণত হয়েছে ।
চতুর্থত । মুখ্য ও গৌণ গুণ গুলােকে আমরা কখনও বিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যক্ষ করি না , বরং মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণগুলােকে আমরা একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করি । যে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা গৌণ গুণগুলােকে প্রত্যক্ষ করি , সেই একই ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা বস্তুর মুখ্য গুণগুলােকে প্রত্যক্ষ করি । গৌণ গুণগুলির মতাে মুখ্য গুণগুলােও ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে । আমরা এমন কোন বস্তু প্রত্যক্ষ করি না যার কেবলমাত্র আকার বা বিস্তৃতি আছে , কিন্তু কোন রূপ বা গন্ধ নেই । সুতরাং , গৌণ গুণগুলাে যদি মনের ধারণা বা সংবেদন হয় , তা হলে মুখ্য গুণগুলােকেও মনের ধারণা বা সংবেদন বলতে হয় । অর্থাৎ উভয় প্রকার গুণই ব্যক্তিগত , বস্তুগত নয় ।
সুতরাং , দেখা যাচ্ছে লক্ জ্ঞেয় বস্তুর প্রকৃতি নিরূপণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং লকের সবিচার বস্তুবাদের অনিবার্য পরিণতি হল আত্মগত ভাববাদ ।