কার্য - কারণ বিষয়ে অভিজ্ঞতাবাদ আলােচনা কর ।

Clg philosophy questions answers কলেজ দর্শন প্রশ্নোত্তর কার্য কারণ বিষয়ে অভিজ্ঞতাবাদ আলােচনা কর karjo karon bishoye abhigyotabad alochona koro


উত্তর : অভিজ্ঞতা : অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকদের মতে , অভিজ্ঞতাই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় । অভিজ্ঞতাকে বাদ দিয়ে অন্য কিছু ভাবতে তাঁরা রাজি হন না । কারণ হল শক্তি যা সক্রিয়ভাবে কার্য উৎপাদন করে — লকের এই মতবাদের তীব্র সমালােচনা করে তাঁরা বলেছেন যে, কোন রকম শক্তির সংবেদন আমরা অভিজ্ঞতায় পাই না ।  


হিউমের কার্য-কারণ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাবাদ : অভিজ্ঞতার ঘটনার মধ্যে কোন অনিবার্য সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করা যায় না । হিউম হলেন সতত সংযােগ তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা । তাঁর মতে , সংবেদন এবং ধারণাই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় । প্রত্যক্ষের সাহায্যে আমরা কোন শক্তির সংবেদন লাভ করি না । এছাড়া, কার্যকারণ সম্পর্ক যেকোন রকম অনিবার্য সম্পর্ক তা হিউম স্বীকার করেন না । দুটি ঘটনা যখন এমনভাবে সম্বন্ধযুক্ত যে, একটি উপস্থিত থাকলে বা ঘটলে আর একটি অবশ্যম্ভাবীভাবে থাকবে না -ঘটবেই , তখন তাদের সম্পর্ককে অনিবার্য সম্পর্ক বলা হয় । বলা হয়েছে , 


কার্যকারণ সম্বন্ধ অনিবার্য সম্বন্ধ অর্থাৎ কার্য যে কেবল অতীতেই  কারণকে অনুসরণ করেছে তা নয় , ভবিষ্যতেও করবে । কিন্তু হিউমের মতে অভিজ্ঞতায় যা পাওয়া যায় না, তার অস্তিত্ব আছে বলা যায় না । অভিজ্ঞতায় আমরা ঘটনার পারস্পর্য সম্বন্ধ এবং সহ - অবস্থান প্রত্যক্ষ করি , কিন্তু কোন অনিবার্য সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করি না । উদাহরণস্বরূপ — ‘বিষপানে মৃত্যু ঘটে’ । সাধারণ দৃষ্টিতে বিষপান এবং মৃত্যুর মধ্যে এক অনিবার্য সম্পর্ক আছে অর্থাৎ বিষপানে মৃত্যু – অতীতেও ঘটেছে , ভবিষ্যতেও ঘটবে । কিন্তু হিউম বলেছেন , বিষপান ও মৃত্যু এই দুই ঘটনার মধ্যে একটি পূর্বাপর সম্পর্ক মাত্র আমরা প্রত্যক্ষ করি , কোন অনিবার্য সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করি না । কাজেই ভবিষ্যতেও বিষ খেলে যে মৃত্যু হবেই — এ কথা জোর করে বলা যায় না । দুটি ঘটনার মধ্যে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তা হল পারস্পর্য অর্থাৎ কালগত সম্বন্ধ , দুটি ঘটনার সতত সংযােগ । বিষের কোন্ শক্তির দ্বারা মৃত্যু ঘটেছে সেই সম্বন্ধে কোন প্রত্যক্ষ জ্ঞান আমাদের হয় না । এইভাবে হিউম কার্যকারণ সম্বন্ধযুক্ত ঘটনার মধ্যে কোন অনিবার্য সম্পর্ক স্বীকার করেন না ।

তবে আমরা কারণ থেকে অনিবার্যভাবে কার্যে আসব — এ ধারণা করি কি করে ? হিউমের মতে অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পাওয়া এটা আমাদের মানসিক অভ্যাস । যেমন — অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতে পাই যে, আগুনে হাত দিলেই হাত পােড়ে । আগুনে হাত দেওয়া ও হাতপােড়া — এই দুটি ঘটনা আমাদের মনে এমনভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়ে যে , প্রথমটি দেখলেই আমরা দ্বিতীয়টিকে প্রত্যাশা করি । সুতরাং , হিউমের মতে কার্যকারণ সম্পর্ক ঘটনার পূর্বাপর সম্পর্কের একরুপতা ছাড়া কিছুই নয় এবং কারণ হল নিয়ত অপরিবর্তিত পূর্ববর্তী ঘটনা এবং কার্য হল নিয়ত অপরিবর্তিত পরবর্তী ঘটনা । এই মতবাদ কার্যকারণ সম্পর্ক বিষয়ে নিয়ত বা সতত সংযােগবাদ বা নিয়ত পারম্পর্যবাদ নামে অভিহিত হয় । প্রকৃতপক্ষে , কারণ ও কার্য দুটি স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা । অভ্যাসপ্রসূত প্রত্যাশা থেকেই কার্যকারণের মধ্যে অনিবার্য সম্বন্ধের ধারণার উৎপত্তি । আসলে এটা মনের কুসংস্কার ছাড়া কিছুই নয় । 


কারণকে বিশ্লেষণ করলে কার্যকে পাওয়া যায় না : বস্তুত কার্য কারণের মধ্যে যদি কোন অনিবার্য সম্পর্ক থাকত তাহলে কারণকে বিশ্লেষণ করলেই কার্যের ধারণা পাওয়া যেত । কিন্তু কারণকে বিশ্লেষণ করলে কার্যের ধারণা পাওয়া যায় না । যেমন , খাদ্যকে যতই বিশ্লেষণ করি না কেন তার মধ্যে ক্ষুধা নিবৃত্তিকে পাওয়া যাবে না । তাছাড়া , কারণ ও কার্য দুটি স্বতন্ত্র ঘটনা , উভয়ের মধ্যে যদি অনিবার্য সম্পর্কের ধারণা করা হয় তাহলে কারণ ও কার্যকে দুটি স্বতন্ত্র ঘটনা বলে অভিহিত করা যাবে না । সুতরাং , কারণ ও কার্যের মধ্যে সেইরকম কোন সম্বন্ধ নেই । সেইজন্য হিউমের মতে এদের যােগাযোেগ নিছক আমাদের অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে বর্তমান । 


সমালােচনা : হিউমের সংযােগ তত্ত্বের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোেগ উত্থাপিত হয়েছে । 

প্রথমত । অনেক ক্ষেত্রে দুটি ঘটনার মধ্যে সংযােগ লক্ষ্য করা গেলেও বলা যুক্তিসঙ্গত হবে না যে তাদের একটি অপরটির কারণ । যেমন বিদ্যুতের চমক ও বজ্রধ্বনি । 

দ্বিতীয়ত । অনেক সময় দুটি ঘটনার সতত সংযােগ লক্ষ্য করা গেলেও দেখা যায় যে , একটি আর একটির কারণ নয় । পরবর্তী ঘটনাটি চিহ্ন বা সংকেত মাত্র । অনুবর্তী ঘটনার কারণটি ভিন্ন কোন বিষয় । যেমন , কলেরা রােগের আবির্ভাবের সঙ্গে কতকগুলি লক্ষণের সতত সযােগ দেখা যায় । কিন্তু সেগুলি কলেরা রােগের কারণ নয় । 

তৃতীয়ত । একবার মাত্র যে ঘটনা ঘটেছে তার ক্ষেত্রে কার্যকারণ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুটি ঘটনার নিয়ত বা সতত সংযােগ তত্ত্বের আশ্রয় গ্রহণ করা সম্ভব কি ? 

চতুর্থত । অনেক কার্যকারণ ঘটনার সম্বন্ধের ক্ষেত্রে সতত সংযােগ লক্ষ্য করা যায় না । যেমন , মশলা জাতীয় খাদ্য গ্রহণে পেটে ঘা হয় । কিন্তু মশলা জাতীয় খাদ্য গ্রহণে সব ক্ষেত্রে পেটে ঘা হয় না । 

পঞ্চমত । মানসিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টতই উপলব্ধি করি যে , আমাদের ইচ্ছাই ঘটনাটিকে নিয়ন্ত্রণ করে । আমি ইচ্ছা করলাম , হাত উপরে তুললাম । কাজেই আমার ইচ্ছা করাই হাত তােলার কারণ । কিন্তু এই দুটি ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যদি বলা হয় যে , হাত তোলা ঘটনাটির নিয়ত আমার ইচ্ছা করার পরেই ঘটে থাকে তাহলে ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রণের ঘটনাটিকে অস্বীকার করতে হয় । কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি এতই স্পষ্ট যে , একে অস্বীকার করা চলে না । 
 
দার্শনিক মিল দেখিয়েছেন যে , কারণ যদি কেবলমাত্র কার্যের অপরিবর্তিত পূর্ববর্তী ঘটনা হয় তাহলে দিন রাত্রির কারণ হবে । অথচ আমরা জানি কেউ কারও কার্য নয় । দুটি ঘটনাই অন্য একটি শর্তের উপর নির্ভর । কাজেই কার্যকারণ কেবলমাত্র অপরিবর্তিত পূর্ববর্তী ঘটনা নয় । মিলের মতে , কারণ হল শর্তহীন অপরিবর্তিত পূর্ববর্তী ঘটনা । কোন রকম শর্তের উপর নির্ভর না করেই কারণকে কার্য নিয়ত অনুসরণ করে । মিলের সংজ্ঞাটি পরােক্ষভাবে কার্য- কারণের মধ্যে যে অনিবার্য সম্পর্ক আছে , তা স্বীকার করে নেয় । 

ষষ্ঠত , হিউমের মতে অভিজ্ঞতায় যা পাওয়া যায় না তা সত্য নয় । কিন্তু অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উপায় নয় । অভিজ্ঞতার সাহায্যে অনিবার্য সম্পর্কের ধারণা কখনই পাওয়া যায় না । কারণ ধারণা অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয় , অভিজ্ঞতার পূর্বগামী । হিউমের মতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন সংবেদনই জ্ঞানের উপকরণ । 

সর্বোপরি : হিউমের মতবাদ স্বীকার করে নিলে আরােহ অনুমান , বিজ্ঞানসম্মত ভবিষ্যৎবাণী বা গণনাকার্যের কোন যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না । কিন্তু কার্যকারণ সম্বন্ধ ও প্রকৃতির একরূপতাকে ভিত্তি করেই বিভিন্ন বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করা হয় । অর্থাৎ , হিউমের মতবাদ মেনে নিলে বিজ্ঞানের সত্যগুলিকে অনিবার্য বলার কোন যুক্তি থাকবে না , সেগুলি হয়ে পড়বে সম্ভাব্য । কিন্তু আমরা জানি বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত সুনিশ্চিত , সম্ভাব্য নয় । 


পূর্বোক্ত : সমালােচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে , কার্যকারণ সম্বন্ধ কেবলমাত্র পূর্বাপর সম্পর্ক নয় বা দুটি ঘটনার নিয়ত বা সতত সংযােগ নয় , এ হল দুটি ঘটনার মধ্যে অনিবার্য সম্পর্ক — মিল স্পষ্টই তা স্বীকার করেছেন । তা হলে এই সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, অভিজ্ঞতার সহায়তায় কার্যকারণ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা চলে না এবং এর ব্যাখ্যার জন্য অন্য উপায় অবলম্বনের প্রয়ােজন ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন