উত্তর : যােগাচার বৌদ্ধগণ মহাযান বা ভাববাদী সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় মাধ্যমিক বৌদ্ধদের মতাে তারাও বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব বা সত্তা অস্বীকার করেছেন । কিন্তু মাধ্যমিকদের মত মন বা চেতনাকে অস্বীকার করেননি । কারণ , মন বা চেতনার সত্তা অস্বীকার করলে মাধ্যমিকগণ যে যুক্তি দ্বারা নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন তার সত্যতা প্রমাণ করা যাবে না ।কাজেই , যুক্তিতর্ক দিয়ে চিন্তার সত্যতা প্রমাণের জন্য মন বা চেতনার অস্তিত্ব মানতে হয় । মাধ্যমিক বৌদ্ধ মত বা চেতনাই একমাত্র সত্য । মন বা চেতনার অতিরিক্ত কোনােকিছুরই সত্তা নেই । বাহ্যবস্তু রূপে যা কিছু প্রতীয়মান হয় সবই মনের ধারণা । এদের মতে বাহ্যবস্তু এবং বহ্যবস্তুর চেতনা এক ও অভিন্ন । কারণ , চেতনার বিষয় নয় এমন কোনাে বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না । যােগাচার বাহ্যবস্তু হল মনের ধারণা , বা সংবেদনের সমষ্টি । চেতনা বহির্ভূত বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করলে অসঙ্গতির সৃষ্টি হয় । এইজন্য যােগাচার বৌদ্ধগণ কয়েকটি যুক্তির সাহায্য বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন ।
১ ) ব্যহ্যবস্তু রুপে যার প্রত্যক্ষ হয় সেটি হল অন্য কিছু দ্বারা সৃষ্ট অথবা বস্তুটি সৃষ্টি নয় । সৃষ্ট বস্তু হলে তার স্থায়ী সত্তা থাকতে পারে না । আর যদি সৃষ্ট বস্তু না হয় অর্থাৎ বস্তুটি যদি উৎপন্ন না হয়ে থাকে তাহলে ওই বস্তুর অস্তিত্বই থাকবে না।
২ ) বাহ্যবস্তুটি হয় পরমাণু অথবা পরমাণু দ্বারা সৃষ্ট কোনাে যৌগিক পদার্থ হবে । যদি পরমাণু হয় তবে তার প্রত্যক্ষ হবে না । যেহেতু , পরমাণুর প্রত্যক্ষ হয় না । আর যদি পরমাণু সংযােগে উৎপন্ন কোনো যৌগিক পদার্থ হয় তাহলে বস্তুটি পরমাণু থেকে হয় ভিন্ন না হয় অভিন্ন হবে । পরমাণু থেকে ভিন্ন হলে তাকে পরমাণু দ্বারাগঠিত — এরকম বলা যাবে না । আবার যদি পরমাণু থেকে অভিন্ন হয় তাহলে তা মানস প্রতিচ্ছবি সৃষ্ট করতে পারবে না ।
৩ ) বস্তুগুলি ক্ষণিক বা একটিমাত্র ক্ষণেই থাকে বলে যে ক্ষণে কোনাে বস্তুকে প্রত্যক্ষ করা হয় সেই ক্ষণে বস্তুটি আর থাকে না । কাজেই ,আমরা অতীত বস্তুরই জ্ঞানলাভ করি । কিন্তু কোনাে বস্তুর জ্ঞান লাভ করার সময় বস্তুটি বর্তমানের বস্তুরূপেই জ্ঞানলাভ করি । কাজেই , জ্ঞানের বিষয়বস্তু কোনাে বাহ্যবস্তু নয় । অর্থাৎ বাহ্যবস্তুর প্রত্যক্ষের জন্য বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব থাকতেই হবে — একথা বলা যায় না । কাজেই , বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা নেই । বাহ্যবস্তুরূপে যা কিছুর জ্ঞান হয় সবই মনের ধারণামাত্র ।
যােগাচার সম্প্রদায়ের দার্শনিক মতবাদকে বিজ্ঞানবাদ বলা হয় । কারণ যােগাচার বৌদ্ধগণ একমাত্র বিজ্ঞান বা চেতনাকেই সত্য বলে স্বীকার করেন । বিজ্ঞানবাদের এই মতকে আত্মগত বিজ্ঞানবাদ বলা যায় । কারণ , এই মত অনুযায়ী জ্ঞানের বিষয় ব্যক্তিমনের ধারণামাত্র ।
এখন , প্রশ্নহল , বস্তুযদি মনের ধারণামাত্র হয়, এবং তার অতিরিক্ত কোনাে অস্তিত্ব না থাকে তাহলে যে কোনাে সময়ে , যে কোনাে বস্তুকে আমরা ইচ্ছামতাে প্রত্যক্ষ করতে পারি না কেন ? এক্ষেত্রে, বিজ্ঞানবাদীরা বলেন , চেতনা - প্রবাহের মধ্যে অতীত অভিজ্ঞতার সমস্ত সংস্কার থাকলেও যে বিশেষ ক্ষণে যে বিশেষ ধারণাটি চেতনার কেন্দ্রে এসে উপস্থিত হয় সেই মুহূর্তে সেই বিশেষ ধারণাটিই প্রত্যক্ষের বিষয় হয় ।
বিজ্ঞানবাদী যােগাচার বৌদ্ধগণ অতীত অভিজ্ঞতার ধারক হিসাবে আলয় বিজ্ঞানের কথা বলেছেন । আলয় বিজ্ঞান হল যেখানে অতীত অভিজ্ঞতার সমস্ত বিষয় এবং সমস্ত - জাগতিক বিষয়গুলি সম্ভাবনা রূপে থাকে । বাসনার প্রভাবে পরবর্তীকালে এগুলির প্রকাশ বিজ্ঞানও শান্তরূপ ধারণ করে এবং ঘটে । কাজেই , বাসনা দূরীভূত হলে আলয় - বিজ্ঞানও শান্তরূপ ধারণা করে এবং চৈতন্যরূপে বিরাজ করে । একেই নির্বাণ বলা হয়েছে ।
যােগ এবং সদাচারের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ হয় — এরূপ মত প্রকাশের জন্যই এদের যােগাচারবাদী বলা হয় । বৌদ্ধ দর্শনিক অসঙ্গ , বসুবন্ধু, দিঙনাগ হলেন যােগাচার বিজ্ঞানবাদের সমর্থক ।
যােগাচার বৌদ্ধদের মতবাদের সাথে পাশ্চাত্য দার্শনিক রেনে দেকার্তের মতের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় । কারণ , তাঁর বিখ্যাত উক্তি “আমি চিন্তা করি সুতরাং আমি আছি” এর অর্থ যেহেতু আমি চিন্তা বা সন্দেহ করি সেহেতু চিন্তান কর্ত্তা বা সন্দেহের কর্ত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় ।
তিনি তার সার্বিক সংশয়বাদে বলেছেন , সবকিছুর অস্তিত্ব বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা গেলেও সন্দেহ বা চিন্তন কৰ্ত্তার অস্তিত্বকে আর সন্দেহ করা যায় না ।কাজেই , সন্দেহ ক্রিয়ার জন্য চেতনার অস্তিত্বকে মানতে হয়