উত্তর : কার্যকারণ বিষয়ে মােটামুটি দুটি মত প্রচলিত আছে- সৎকাৰ্যবাদ এবং অসৎকাৰ্যবাদ । যে মতবাদ অনুযায়ী উৎপত্তির পূর্বে কার্যটি তার উপাদান কারণে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান সেই মতবাদই সৎকাৰ্যবাদ । আর , অসৎকাৰ্যবাদ অনুযায়ী কার্যটি উৎপত্তির পূর্বে তার কারণে কোনভাবেই থাকে না । কার্যটি নতুন করে সৃষ্টি হয়। সাংখ্যদার্শনিকগণ সৎকার্যবাদের সমর্থক । তারা সৎকার্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রথমে অসৎকাৰ্যবাদ খণ্ডন করে পরে সৎকাৰ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন । অসৎকার্যবাদীদের সমর্থক হলেন নৈয়ায়িক এবং বৌদ্ধ দার্শনিকগণ । তাদের যুক্তি হল –
[ ] অসৎকাৰ্যবাদের পক্ষে যুক্তি :
১ ) কার্যটি উৎপত্তির পূর্বে উপাদান কারণে থাকলে কার্যটি উৎপন্ন হয়েছে — একথা বলা যায় না । কারণ , উৎপত্তির অর্থ যা ছিল না তার আবির্ভাব ।
২ ) কার্যটি উপাদান কারণে থাকলে কাৰ্যেৎপত্তির জন্য নিমিত্ত কারণের প্রয়ােজন হতাে । কিন্তু মৃত্তিকা নির্মিত ঘট কুম্ভকারকে অপেক্ষা করেই উৎপন্ন হয় ।
৩ ) কার্যটি কারণে থাকলে কার্য ও কারণের নাম ভিন্ন হত না ,তারা পরস্পর অভিন্ন হত । অর্থাৎ মৃত্তিকা এবং ঘট একই হতাে । কিন্তু এদুটি এক নয় ।
৪ ) কার্যটি কারণে থাকলে কার্য এবং কারণের মধ্যে কোনাে ভেদ থাকত না, তারা পরস্পর অভিন্নই হত , এবং উভয়েই একই প্রয়ােজন সিদ্ধ করতে পারত ।কিন্তু মৃত্তিকা দ্বারা ঘটের প্রয়ােজন সিদ্ধ হয় না ।
সাংখ্য দার্শনিকগণ সৎ কার্যবাদী হিসেবে নৈয়ায়িক ও বৌদ্ধদের অসৎকাৰ্যবাদ খন্ডন করে সাৎকাৰ্যবাদের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন ।
[ ] সাৎকাৰ্যবাদের পক্ষে সাংখ্যের যুক্তি :
১ ) কার্যটি তার উপাদন কারণে না থাকলে এবং কার্যটি নুতন সৃষ্টি হলে কার্যটি শূন্য থেকেই সৃষ্টি হয়েছে একথাই বলতে হয় । কিন্তু শূন্য থেকে কোন কিছু সৃষ্টি হতে পারে না । কাজেই মানতে হয় যে কার্যটি সৃষ্টির পূর্বেও ছিল ।
২ ) কার্যটি তার উপাদান কারণে না থাকলে কুম্ভকারের পক্ষে ঘট উৎপন্ন করা সম্ভব হতাে না ।যেমন — নীল রংকে শত চেষ্টা দ্বারাও লাল রং - এ পরিণত করা যায় না । সাংখ্য মতে , উপাদান কারণে যে কার্যটি প্রচ্ছন্ন বা অব্যক্ত থাকে সেই অব্যক্ত অবস্থাকে ব্যক্ত করার জন্যই নিমিত্ত কারণের প্রয়ােজন হয় । কাজেই স্বীকার করতে হয় যে কার্যটি তার উপাদান কারণে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে ।
৩ ) কার্যটি তার উপাদান কারণে থাকে বলেই বিশেষ কারণ থেকে বিশেষ কার্য উৎপন্ন হয় অর্থাৎ যে কারণের সাথে যে কার্যের কার্য-কারণ সম্বন্ধ থাকে কেবল সেই কারণ থেকে ঐ বিশেষ কার্যটিই উৎপন্ন হতে পারে ,অন্য কোনাে উপাদান থেকে ওই কার্য উৎপন্ন হয় না । যেমন — দুধ থেকে দই হলেও তেল থেকে বা জল থেকে হয় না ।
৪ ) কার্যটি যদি তার উপাদান কারণে না থাকত অর্থাৎ কার্যটির যদি নতুন আবির্ভাব ঘটত তাহলে যেকোন উপাদান থেকে যেকোন কার্যই উৎপন্ন হতে পারত । কিন্তু নির্দিষ্ট কারণ থেকে নির্দিষ্ট কার্যই উৎপন্ন হয় । যেন — বীজ থেকে গাছ হলেও যে কোন বীজ থেকে যে কোন গাছ উৎপন্ন হয় না ।কাজেই , কার্যটি তার উপাদান কারণে থাকে —এরূপ মানতে হয় ।
৫ ) যে কারণে যে কার্যের সম্ভাবনা থাকে সেই কারণ থেকে কেবল সেই কার্যটি উৎপন্ন হয় । যেমন — মৃত্তিকা দ্বারা মৃত্তিকা নির্মিত ঘট উৎপাদন করা গেলেও স্বর্ণ নির্মিত ঘট উৎপন্ন করা যায় না ।কাজেই , স্বীকার করতে হয় যে মৃত্তিকা উপাদান কারণে মৃত্তিকা নির্মিত ঘটের সম্ভাবনা থাকে কিন্তু স্বর্ণ-নির্মিত ঘটের সম্ভাবনা থাকে না । অর্থাৎ উৎপত্তির পূর্বে কার্যটি তার উপাদান কারণে থাকে ।
৬ ) সাংখ্য মতে , কারণ ও কার্য স্বরূপতঃ অভিন্ন, ভিন্ন নয় । যেমন মৃত্তিকা এবং মৃত্তিকা নির্মিত ঘট স্বরূপতঃ অভিন্ন । কাজেই , কারণের অস্তিত্ব দ্বারাই কার্যের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় ।
কার্যকারণ সম্পৰ্কীয় সাংখ্য মতই সৎ কাৰ্যবাদ নামে পরিচিত । সকাৰ্যবাদের আবার দুটি রূপ আছে— ( ১ ) পরিণামবাদ এবং ( ২) বিবর্তনবাদ । বিবর্তনবাদ অনুযায়ী কার্যটি হল কারণের মিথ্যা কার্য । যেমন— রজ্জুসৰ্প স্থলে রজ্জ্বটি সত্য হলেও কার্য সর্পটি মিথ্যা হয় । বিবর্তনবাদকে সমর্থন করেন বেদান্তীরা । তারা ব্রহ্মকে ( কারণ ) সত্য বলে জগৎ রুপ কার্যকে মিথ্যা বলেছেন ।
আর , পরিণামবাদ অনুসারে কারণ এবং কার্য উভয়ই সৎ । যেহেতু ,কারণটিই কার্যে জগতে পরিণাম প্রাপ্ত হয় । সাংখ্য মতে , প্রকৃতিই জগতে পরিণাম প্রাপ্ত হন । কাজেই , প্রকৃতি যেমন সত্য জগৎও সত্য । জগৎ হল প্রকৃতির পরিণাম । এজন্য সাংখ্যের সৎকাৰ্যবাদ হল পরিণামবাদ ।