উত্তর : জৈন দর্শনে মােক্ষ বা মুক্তির আলােচনা তাদের তত্ত্ববিদ্যার আলােচনার অন্তর্গত । মােক্ষ বা মুক্তি কথার অর্থ বন্ধন মুক্তি । বন্ধন মাত্রই জীবের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য । জৈন দর্শনে জীব এবং আত্মা অভিন্ন বলা হয়েছে । জীব বা আত্মা স্বরূপতঃ পূর্ণ; জীব অনন্ত দর্শন , অনন্ত জ্ঞান এবং অনন্ত আনন্দের অধিকারী হলেও কামনা -বাসনাজনিত কর্মশক্তির প্রভাবে জীব পুদগলের সংস্পর্শে এসে বদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হয় । ফলে , জীব বা আত্মার এই বদ্ধ অবস্থার কারণে আত্মা নিজের স্বরূপকে জানতে পারে না । কাজেই , আত্মা পুদগল মুক্ত হলেই মুক্তি লাভ করে । বদ্ধ অবস্থায় জীব বা আত্মা যে দুঃখভােগ করে মুক্ত অবস্থায় সেই দুঃখের কেবল অবসানই হয় না , জীব নিজ স্বরূপে অবস্থান করে বলে অনাবিল আনন্দও লাভ করে । জৈন মতে , আত্মার পূর্ণ বিকাশই মােক্ষ বা মুক্তি।
জৈন মতে , আত্মা বা জীবের মুক্তির জন্য প্রয়ােজন আত্মায় নতুন কর্ম পুদগলের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা এবং পূর্ব থেকে যে সমস্ত কর্ম পুদগল আত্মায় সংযুক্ত হয়ে আছে তাদের প্রভাব রােধ করা । কাজেই , আত্মা যখন সম্পূর্ণ পুদগল মুক্ত হয় তখনই জীব বা আত্মা নিজের স্বরূপ অর্থাৎ অনন্ত দর্শন, অনন্ত জ্ঞান এবং অনন্ত আনন্দ লাভ করে । এই অবস্থাকেই মােক্ষ বা মুক্তি বলা হয়েছে । এ জন্য জৈন মতে , আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশই মােক্ষ বা মুক্তি । জৈন দর্শনে আত্মায় নতুন কর্ম - পুদগলের অনুপ্রবেশ রােধ করাকে সংবর এবং সঞ্চিত কর্ম পুদগলের অপসারণকে নির্জরা বলা হয় । কাজেই , সংবর এবং - নির্জরা — এই দুটি ক্রিয়া দ্বারা জীব বা আত্মা মােক্ষ লাভ করে ।
কিন্তু এই দুটি ক্রিয়া কিভাবে সম্ভব ? —এই প্রশ্নের উত্তরে কামনা -বাসনা চরিতার্থ করতে গিয়েই আত্মায় পুদগলের সংযুক্তি ঘটে । কামনা -বাসনার উৎপত্তি অজ্ঞানতা থেকে । কাজেই , সত্য ও যথার্থ দ্বারা অজ্ঞানতা দূর হয় । তাই জৈন মতে , মুক্তি বা মােক্ষের জন্য প্রয়ােজন সম্যক্ - জ্ঞান । সম্যক - জ্ঞানের জন্য প্রয়ােজন সম্যক্ দর্শনের । কিন্তু কেবলমাত্র সম্যক্ -জ্ঞান এবং সম্যক দর্শন দ্বারা মুক্তি সম্ভব নয় । জৈন মতে , সম্যক্- জ্ঞান, সম্যক্ - দর্শন ছাড়াও সম্যক -চারিত্রের প্রয়ােজন । কোন কোন জৈনগণ আবার পঞ্চমহাব্রতকেও মুক্তির সহায়ক বলে মনে করেন ।
জৈন দর্শনে সম্যক্- জ্ঞান, সম্যক্-দর্শন এবং সম্যক্ চারিত্রকে ত্রিরত্ন বলা হয়েছে । মুক্তি বা মােক্ষ হল এই ত্রিরত্নের যুগ্ম ফল । উমাস্বামীর তত্ত্বৰ্থাধিগমসূত্রে এই ত্রিরত্নকেই মােক্ষের পথ বলা হয়েছে ।
সম্যক্ - দর্শন— উমাস্বামীর মতে , সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাই সম্যক্-দর্শন । তীর্থঙ্করদের উপদেশকে নির্বিচার বিশ্বাস করা নয় , বিচার -বিশ্লেষণের দ্বারা যে সম্যক্ শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস উৎপন্ন হয় , সেই শ্রদ্ধা সহকারে তীর্থঙ্করদের উপদেশাবলী পাঠ বা শ্রবণ করলে তীর্থঙ্করদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে । সত্যের প্রতি এরূপ শ্ৰদ্ধার কথাই বলা হয়েছে । সম্যক্ - জ্ঞান-জৈন মতে , আত্মা এবং অনাত্মার সম্পর্কে অনিশ্চয়তা , ভ্রম এবং সংশয়মুক্ত যে বিস্তারিত জ্ঞান তাই সম্যক্ জ্ঞান । সম্যক্ জ্ঞানের জন্য প্রয়ােজন সহজাত প্রবৃত্তিগুলির অপসারণ , যা সম্যক্- জ্ঞানের ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ ।
সম্যক্ - চারিত্র— সম্যক্- চারিত্র-এর মূল কথা হল অন্যের ক্ষতি বা অকল্যাণকর কিছু না করা । জৈন মতে , সম্যক -চারিত্র দ্বারা আত্মায় কর্ম- পুদগলের অনুপ্রবেশ বন্ধ হয় এবং সঞ্চিত কর্মপুদগলের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যায় ।