উত্তর : যােগ কী : ‘যােগ’ কথাটির অর্থ হল চিত্রবৃত্তি নিরােধ । ‘যুজ’ ধাতুর ‘ঘঙ’ প্রত্যয়যােগে ‘যােগ’ শব্দটি উৎপন্ন হয় । ‘যুজ’ ধাতুর আক্ষরিক অর্থ সংযােগ । অর্থাৎ যােগের দ্বারা জীবাত্মা ও পরমাত্মার সংযােগ ঘটে । কিন্তু অরবিন্দ যােগ বলতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনকে বােঝাতে যাননি , কারণ তিনি মনে করতেন জীবাত্মা ও পরমাত্মা ভিন্ন নয় । জীব ব্রহ্মের প্রকাশ মাত্র । এই কারণেই অরবিন্দের যােগকে ‘অখন্ড যােগ’ বলা হয় ।
অখন্ড যােগ কী ? “ অখন্ড ” — অর্থাৎ যা খন্ড নয় । অরবিন্দের মতে এক , অদ্বয়, সচ্চিদানন্দ পরমব্রয়ই মূলতত্ত্ব । পরমব্রত্ম বহুরূপে প্রকাশিত । প্রতিটি মানুষের মধ্যেই তার প্রকাশ । যেমন কোনাে বীজের মধ্যে সমগ্র বৃক্ষটি সুপ্ত অবস্থায় থাকে । প্রকৃতির কোলে , প্রকৃতির আঙিনায় ঘুমন্ত বীজটি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে মহীরুহে পরিণত হয় । তেমনি যােগ সাধনার মাধ্যমে ঘুমন্ত বীজটি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে পরমাত্মার পূর্ণরূপ দান করে এবং অখন্ড যােগ তখনই বলা যাবে যখন ব্যক্তি এবং পরমাত্মা , পরমাত্মা এবং ব্যক্তি মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে । অর্থাৎ উদাহরণ হিসাবে মহাপ্রভুর গৌরাঙ্গ মূর্তির কথা বলা যেতে পারে । যেখানে রাধা এবং কৃষ্ণ, কৃষ্ণ এবং রাধা যুগল মূর্তি একসঙ্গে প্রকাশিত ।
মানসােত্তর চেতনা : ব্রত্মের চেতনা আমাদের মনের নাগালের বাইরে , সেজন্য এমন চেতনাকে ‘ ‘মানসােত্তর চেতনা’ বলা হয় । মনের থেকে উন্নততর তত্ত্ব যে অতিমন আমাদের মধ্যে নিহিত ও সুপ্ত রয়েছে তাকে জাগ্রত করতে পারলেই কেবল আমরা মানসােত্তর চেতনায় পৌঁছাতে পারি । রবীন্দ্রনাথের ভাষায় –
“তােমার মাঝে আমার প্রকাশ তাই এত মধুর ।”
তিনটি স্তর : ঈশ্বরােপলব্ধির জন্য অধ্যাত্মবাদীরা বুদ্ধি, আবেগ , ইচ্ছা ইত্যাদি বিভিন্ন মানসবৃত্তির চর্চা এবং প্রসার ঘটাতে চেয়েছেন । ‘ব্যক্তিসত্তা সীমিত দেহ , প্রাণ এবং মনের সঙ্গে অভিন্ন ।’ এরকম ভ্রান্ত ধারণাকে বৌদ্ধিক পথে দূর করার চেষ্টা হয়েছে । একথা জানানাের চেষ্টা করা হয়েছে যে ঈশ্বরের সেই পরম প্রকৃত সত্তা যা প্রতিটি ব্যক্তির অস্তিত্বে লীন হয়ে আছে । যদিও আধ্যাত্মিক উপলদ্ধির জন্য উপরিউক্ত তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মানসবৃত্তির চর্চা আবশ্যিক তবু মানুষ যে সর্বোত্তম লক্ষে পৌঁছাতে সক্ষম সেখানে পৌঁছানাের পক্ষে এরকম চর্চা যথেষ্ট নয় । কেননা , অরবিন্দ দেখান যে উপরিউক্ত আধ্যাত্মিক উপলব্ধি সমগ্র মানবজাতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার বদলে মূলত ব্যক্তি সাধকের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ।
কঠিন সাধনা : যােগ এক কঠিন সাধনা , এক কঠিন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থূল মনকে ক্রমশঃ উন্নত করে পূর্বোক্ত অতিমানস স্তরে ব্যক্তির পক্ষে পৌঁছানাে সম্ভব — ( ১ ) প্রথমে স্থূল মনকে সেই উন্নততর মনে উন্নীত করতে হবে যে মন সবসময়েই প্রবলভাবে সত্যের ধারণা । সচ্চিদানন্দ ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তা করে এবং এই চিন্তার মাধ্যমে ইচ্ছা , আবেগ , প্রাণ, দেহ ইত্যাদিকে বিশুদ্ধ এবং গতিশীল করে । ( ২ )এই মনকে এবার সেই আলােকিত মনে উন্নীত করতে হবে যে মন পরমসত্তার অন্তর্নিহিত আলােক গ্রহণ করে এবং সেইসঙ্গে নিম্নতর জৈবিক এবং দৈহিক উপাদানসমূহকে আরাে রূপান্তরিত করে । ( ৩ )এই উন্নীত মনকে এবার সেই স্বজ্ঞায় উপনীত করতে হবে যে স্বজ্ঞা তাদত্মবােধের মাধ্যমে পরমসত্তার প্রত্যক্ষ জ্ঞান প্রকাশে সক্ষম ।
শেষ কথা : ঋষি অরবিন্দের অখণ্ডযােগের ভাবনা আধ্যাত্মিক ভারতীয় দর্শনের ভাবনায় এক অভিনব সংযােজন যেখানে বিশ্বকে ঐক্যভূত করার কথা বলা হয়েছে । সেইজন্য অখণ্ডযােগ আজও নিজের ভাবমূর্তিতে বিরাজমান ।