ভূমিকা : ১৮৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকার হাভার্ডে কর্মযােগ , জ্ঞানযােগ ও ভক্তিযােগের উপর বক্তৃতা দেন ,পরে তার এই বক্তৃতায় বিষয়ভিত্তিক সংকলন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । যার নাম ‘Karma yoga’ বিবেকানন্দের এই ‘কর্মযােগ ’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের শীর্ষনাম ‘কর্ম’ এবং চরিত্রের উপরে তার প্রভাব । প্রথমে বিবেকানন্দ এই শীর্ষনামের অন্তর্ভুক্ত ‘কর্ম’ ও ‘চরিত্র’ শব্দ দুটির অর্থ স্পষ্ট করেছেন । সংস্কৃত ভাষায় ‘কৃ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন কর্ম কথাটি ‘কাজ’ করা বােঝায় । আধিবিদ্যক আলােচনায় ‘কর্ম’ বলতে আমাদের অতীত কর্মের কারণ থেকে উৎপন্ন ফলকে নির্দেশ করা হয়ে থাকে । বিবেকানন্দের মতে , সর্বক্ষণই কর্মে নিমগ্ন থাকা বা সমস্ত কর্ম থেকে দূরে থাকা কোনােটাই কাম্য নয় । কর্মযােগ প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ ‘কর্ম’ বলতে কেবল ‘কাজ’ কে বুঝিয়েছেন । এই কাজের সঙ্গে আবার জ্ঞানের ওতপ্রােত যােগ রয়েছে । ‘চরিত্র’ বলতে তিনি ব্যক্তির ‘মানসপ্রবণতার সমষ্টি’ বা ‘মনের প্রবৃত্তির সমন্বয়’কে বুঝিয়েছেন । এই মানস প্রবণতা সুখাভিমুখী নয় , জ্ঞানাভিমুখী ।
যােগ বিদ্যার আচার্যগণ তাই বলেন , “ধর্ম কেবল পূর্বকালীন অনুভূতির উপর স্থাপিত নয় , পরন্তু স্বয়ং এই সকল অনুভূতিসম্পন্ন না হলে কেহই ধার্মিক হইতে পারে না । যে বিজ্ঞানের দ্বারা এই সকল অনুভূতি হয় তাহার নাম ‘যােগ’ । ধর্ম যতদিন না অনুভূত হইতেছে , ততদিন ধর্মের কথা বলাই বৃথা । ভগবানের নামে এত গন্ডগােল , যুদ্ধ ও বাদানুবাদ কেন ? ভগবানের নামে যত রক্তপাত হইয়াছে , অন্য কোনাে বিষয়ের জন্য এত রক্তপাত হয় নাই , কারণ সাধারণ মানুষ ধর্মের মূল উৎসে যায় নাই ।
যােগের অষ্টঅঙগ :
( ১ ) যম : অহিংসা , সত্য , অস্তেয় , ব্ৰত্মচর্য ও অপরিগ্রহ — এই পাঁচটি বিষয়ের সাধনাকে ‘যম ’ বলা হয় । কায়, মন ও বাক্যের দ্বারা কোনাে প্রাণীকে বধ না করা বা ব্যথা না দেওয়ার নামই ‘অহিংসা’ ।
( ২ ) নিয়ম : শৌচ , সন্তোষ , তপস্যা , স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রণিধান — এই পাঁচটি অনুষ্ঠান নিয়মের অন্তর্ভুক্ত । স্নানাদির দ্বারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থেকে ‘বাহ্য শৌচ’ আর সৎচিন্তা ,মৈত্রী, দয়া প্রভৃতির ভাবনার দ্বারা ‘অন্তঃশৌচ’ সম্ভব হয় । শ্রদ্ধার সঙ্গে শাস্ত্র নির্ধারিত ব্রত উদযাপন করবার নাম ‘তপস্যা’ বেদ , গীতা প্রভৃতি শাস্ত্রগ্রন্থ নিয়মিত অধ্যয়ন করাই ‘স্বাধ্যায়’ ঈশ্বরচিন্তা এবং ঈশ্বরে সর্বকর্ম সমর্পণ করার নাম ‘ঈশ্বর প্রণিধান’ ।
( ৩ ) আসন : দেহকে সুস্থ এবং মনকে স্থির রাখবার যে বিভিন্ন দেহভঙ্গি বা দেহাবস্থান তাই ‘আসন’ ও সমাধি লাভের জন্য দেহের সুস্থতা এবং মনের স্থিরতা অপরিহার্য । আসন অভ্যাস করা প্রথমে কষ্টকর হলেও অভ্যস্ত হওয়ার পর তা আর কষ্টকর মনে হয় না ।
( ৪ ) প্রাণায়াম : শ্বাস ও প্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে স্বায়ত্তকরাই ‘প্রাণায়াম’ ।প্রাণায়াম তিন প্রকার — যথা রেচক বা বাহ্যবৃত্তি ।শ্বাস গ্রহণ করে তাকে ভেতরে স্থির রাখবার নাম পূর্বক বা অভ্যন্তর বৃত্তি । শ্বাসকে যথারীতি ত্যাগ না করে ভিতরে স্থির রাখবার নাম পূরক বা অভ্যন্তর বৃত্তি, শ্বাসকে যথারীতি ত্যাগ না করে ভিতরে দীর্ঘসময় রাখবার নাম কুম্ভক বা স্তম্ভবৃত্তি, প্রাণায়াম প্রক্রিয়ার দ্বারা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াশক্তি বাড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে কোনাে বিষয়ে মনােনিবেশের ক্ষমতাও বৃদ্ধিপায় । ফলে স্থিরভাবে কোনাে বিষয়ে চিত্ত নিবিষ্ট করা সম্ভব হয় ।
( ৫ ) প্রত্যাহার : ইন্দ্রিয়গুলিকে তাদের নিজ নিজ বিষয় থেকে সরিয়ে এনে চিত্তের অনুগামী করবার নাম ‘প্রত্যাহার’ ইন্দ্রিয়গুলিকে নিজ নিজ বিষয় থেকে সরিয়ে আনা কষ্টসাধ্য বটে ,কিন্তু অসাধ্য নয় ।
( ৬ ) ধারনা : চিত্তকে বিশেষ কোনাে বিষয়ে স্থির বা আবদ্ধ রাখবার নাম ‘ধারণা’ । নিজ দেহের নাভিচক্র , না হয় নাকের অগ্রভাগ , না হয় ক্রুদ্বয়ের মধ্যস্থল অথবা দেবমূর্তি প্রভৃতি বাহ্যজগতের যেকোনাে বিষয়ে চিত্তকে নিবিষ্ট করা যেতে পারে ।
( ৭ ) ধ্যান : যে বিষয়ে চিত্তকে স্থির করা হয়েছে সেই বিষয়ে অবিচ্ছিন্ন ভাবনাকে ‘ধ্যান’ বলে । ধ্যান এবং ধারার মধ্যে পার্থক্য এই , ধ্যান অবিচ্ছিন্ন আর ধারণা বিচ্ছিন্ন ।
( ৮ ) সমাধি : ধ্যানের পরিনাম হল সমাধি । সমাধিতে যােগীর জগৎ সম্বন্ধে , নিজ সম্বন্ধে এমনকি ধ্যান সম্পর্কেও কোনাে জ্ঞান থাকে না, কারণ সমাধিতে যােগীর চিত্ত আরাধ্য বস্তুতে সম্পূর্ণরূপে লীন হয়ে যায় ।