অরবিন্দের দর্শনে প্রকৃতি , ঈশ্বর ও মানবসত্তা কিভাবে প্রতিভাত হয়েছে আলােচনা করো ।

অনাস পাস দর্শন honours pass general philosophy questions answers প্রশ্নোত্তর অরবিন্দের দর্শনে প্রকৃতি ঈশ্বর ও মানবসত্তা কিভাবে প্রতিভাত হয়েছে আলােচনা করো arobinder dorshone prokriti eswar o manobsotta kivabe protivat hoyeche alochona koro


উত্তর : দার্শনিক অরবিন্দ : বেদান্তের যে প্রাচীনতর পর্যায় থেকে পরবর্তীকালে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব , অরবিন্দের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গী মূলতঃ সেই বেদান্ত থেকেই গৃহীত । বিশেষতঃ ঈশােপনিষদ এবং ভগবদগীতার সংশ্লেষক দৃষ্টিভঙ্গী আত্মস্থ করে অরবিন্দ বেদ এবং উপনিষদের ব্যাখ্যা করেছেন । The Life Divine গ্রন্থ লিখতে শুরু করার সময়ে তিনি ঈশােপনিষদের ওপর একটি ভাষ্য রচনা করেন এবং সেখানেই তার সমগ্র দর্শনের মূল পরিকল্পনাটি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হয় । ঈশ্বর , প্রকৃতি ,মানুষ । মানুষের সামাজিক কর্তব্য এবং মানুষের পরম আধ্যাত্মিক প্রয়াস সম্পর্কে তাঁর সংশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গীকে তিনি তার Essays on the Gita ও The Life Divine গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করেন । 

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে । যাঁকে জানলে সব কিছুই জানা হয় সেই পরমসত্তাকে আবিষ্কার করাই দর্শনের লক্ষ্য । অরবিন্দ মনে করেন এই অদ্বৈততার আদর্শ বিজ্ঞানে অনুসৃত হয়েছে । অবসিক জগতের আপাতঃ বৈচিত্র্য ও বহুত্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞান ক্রমাগতঃ লঘু থেকে লঘুতর সংখ্যার । কিন্তু ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর বিস্তৃতির নিয়ম আবিষ্কার করতে চেয়েছে এবং এভাবেই একটি পরম নিয়ম আবিষ্কারের লক্ষ্যে এগিয়েছে । 


বস্তুবাদের অসম্পূর্ণতা : অরবিন্দ বলেন , কোনাে কোনাে দার্শনিক এইসব সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে গিয়ে বিজ্ঞান আবিষ্কৃত সত্যকে পরম , সম্পূর্ণ সত্য হিসাবে গ্রহণ করেন । তাঁরা বস্তুকে বা ভৌত শক্তিকে বা ভৌত অবভাষিক জগতের দেশকালগত কাঠামােকে , সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অন্তলীন সত্তা বলে মনে করেন এবং তাই দিয়েই তারা প্রাণ, মন , এমনকী আত্মা ও অন্যান্য উন্নততর মূল্যকেও ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হন । বিচার বুদ্ধির এই দাবীকে বস্তুতান্ত্রিক অদ্বৈতবাদ যথােচিত গুরুত্ব দেয় না । কোনাে অচেতন ছাঁচ ( তা সে বস্তু , শক্তি বা দেশ - কাল ,যা - ই হােক না কেন ) থেকে চেতনার বিবর্তন হতে পারে বলে ভাবা যায় না , যদি চেতনা ওই অচেতন ছাঁচের মধ্যে প্রথম থেকেই অন্তর্লীন হয়ে না থাকে । আগে যার অস্তিত্ব ছিল না সেটা যে কেমন করে অস্তিত্বশীল হতে পারে তা বিচারবুদ্ধি দিয়ে বােঝা যায় না । এছাড়া অরবিন্দ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গীয় অন্যান্য যেসব ত্রুটি লক্ষ্য করেছেন সেগুলাে হল : ( i ) এই মতবাদ এই শৃঙ্খলাবদ্ধ জগতকে অচেতন উপাদান থেকে আকস্মিকভাবে সৃষ্ট জগৎ হিসাবে ব্যাখ্যা করতে চায় । ( ii )মানুষের দেশ কাল  অতিশায়ী অভীষ্ট এবং গভীরতর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে বুঝতে এবং মানুষের উচ্চতর আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষাকে তৃপ্ত করতে ব্যর্থ হন । অরবিন্দের মতে ,বস্তুবাদের অসম্পূর্ণতা এড়াতে আমরা এমন এক অবস্থানে পৌঁছে যেতে পারি যে অবস্থানে আত্মাকে বস্তু থেকে স্বতন্ত্র অন্য এক ধরনের সত্তা বলে গ্রহণ করা হয় এবং এভাবে এক আধিবিদ্যাতে দ্বৈততার সৃষ্টি হয় । আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার উর্ধ্বগামী যাত্রায় বস্তুবাদের পরের স্তরই দ্বৈতবাদ । বস্তুবাদ থেকে দ্বৈতবাদে পৌঁছানাের এটা স্পষ্ট হয় যে ভৌত দেহের সঙ্গে আত্মা নিজের যে ভ্রমাত্মক একাত্মতা স্থাপন করেছিল তার থেকে সে জেগে উঠেছে এবং ভৌত বস্তু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ওইসব বস্তুকে সে সাক্ষী বা বার্তা হিসাবে পর্যবেক্ষণ করেছে । বস্তু থেকে নিজেকে সফলভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারায় ব্যক্তি আত্মা নিজেকে বস্তুর প্রতি বন্ধন জাত দুঃখ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে । ভারতীয় দর্শনে সাংখ্য এবং যােগসম্প্রদায় এ ধরনের দ্বৈতবাদের কথা এবং দুঃখ অতিক্রমের জন্য বৈরাগ্যের কথা বলেছে । কিন্তু এ ধরনের দ্বৈতবাদকেও অরবিন্দ অসম্পূর্ণ বলে মনে করেছেন । যদি আত্মা এবং বস্তুকে (বা বিষয়ী ও বিষয়কে ) দুটি পরস্পর বিরােধী , স্বতন্ত্র, পরস্পর নিরপেক্ষ সত্তা বলে মনে করা হয় তবে ওই দুটি যে কেমন করে সংযুক্ত এবং সামঞ্জস্যভাবে সমন্বিত থাকে । 



দ্বৈতবাদ : এ ধরনের অধিবিদ্যক দ্বৈতবাদ থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার বিভিন্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে এবং এরকম প্রয়াস থেকে নানা ধরনের আধ্যাত্মিক অদ্বৈতবাদের সৃষ্টি হয়েছে । কোনাে কোনাে বিষয়ীবাদী কর্তার বা দ্রষ্টার মৌল সত্তার উপর জোর দিয়েছেন এবং সব বস্তুকেই কর্তার এরকম ধারণা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন যা কর্তার বাইরে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয় । এ ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ নেই যে পরমব্রত্মের এই ধারণা ব্ৰত্মাকে সব দ্বন্দ্ব এবং বিরােধের উপরে স্থাপন করে । ব্রত্মের সঙ্গে অভিন্ন হওয়ার আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ব্যক্তিকে সব দুঃখ উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করে । ব্রহ্ম থেকে সৃষ্টির রহস্যের সমাধানকল্পে বেদ উপনিষদে কিছু সহায়ক ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে । গীতায় এবং নানান তন্ত্রেও ব্যাপারে নানারকম বক্তব্য রাখা হয়েছে । অরবিন্দ এসব উৎসের ভিত্তিতেই তার নিজস্ব সংশ্লেষক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তুলেছেন । তার মতে , পরমসত্তা ব্রহ্ম কেবল নির্বিশেষ এবং জগৎ অতিশায়ীই নয় , স্ব সমীকরণ এবং স্ব বিশেষীকরণের মাধ্যমে নিজেকে ক্ৰমশঃ সৃষ্টিশীল প্রকাশে ব্যক্ত করতেও সক্ষম । তাই , অরবিন্দ মনে করেন , ব্রহ্ম এই অর্থে নির্বিশেষ যে কোনাে বিশেষণ দিয়ে ব্ৰষ্মকে সীমিত করা যায় না । কিন্তু ব্ৰত্ম এই অর্থে নির্বিশেষ নয় যে তিনি নিজেকে বিশেষিত করতেই সক্ষম নয় । 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন