উত্তরঃ যােগসূত্রে ‘যােগ ’ শব্দে অর্থ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে , ‘যােগঃ চিত্তবৃত্তি নিরােধঃ’ — অর্থাৎ চিত্তবৃত্তির নিরােধই যােগ । সাধারণতঃ ‘যােগ ’ শব্দটি যুক্ত করা বা সংযােগ অর্থেই ব্যবহৃত হয় । অনেকের মতে , যােগ বলতে বােঝায় জীবাত্মার সাথে পরমাত্মা বা ঈশ্বরের সংযােগকে । কিন্তু যােগ সূত্রে যােগ বলতে সমাধিকেই বােঝায় ।
যােগদর্শনের যােগের ক্ষেত্রে আটটি অঙ্গ বা পথের কথা বলা হয়েছে । এজন্য , এই আটটি অঙ্গকে একত্রে অষ্টাঙ্গ যােগও বলা হয় । আসলে এই আটটি হল যােগের আটটি স্তর । এই আটটির কোন একটি দ্বারাই সাধনা সম্ভব নয় । এজন্য এই আটটিকে সাধনার আটটি অঙ্গ বলা হয়েছে । এই অঙ্গ আটটি পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, একই সাধনার বিভিন্ন স্তর । যােগ দর্শন অনুসারে এই অষ্টাঙ্গ যােগ দ্বারা সাধনার মাধ্যমে জীবাত্মার আত্মােপলব্ধি ঘটে । যােগের এই আটটি অঙ্গ হল— ( ১ ) যম , ( ২ ) নিয়ম , (৩ ) আসন ( ৪) প্রাণায়াম, ( ৫ ) প্রত্যাহার , (৬ ) ধারণা ( ৭ ) ধ্যান এবং (৮ ) সমাধি ।
১ ) যম : অষ্টাঙ্গ যােগের প্রথম অঙ্গ হল যম । যােগদর্শনে অহিংসা , অস্তেয়, সত্য , ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ এই পাঁচটিকে যম বলা হয়েছে । অহিংসার অর্থ কায়মনােবাক্যের দ্বারা কাউকে আঘাত না করা । অহিংসা আবার তিন প্রকার কায়িক বা শারীরিক , বাচিক এবং মানসিক । শারীরিক বা কায়িক অহিংসা হল শারীরিক ভাবে কাউকে আঘাত না করা , কাউকে অহিংসার অর্থ বাক্যের দ্বারা কাউকে আঘাত না করা আর মানসিক অহিংসা হল মানসিক ভাবে কাউকে হিংসা না করা । সত্য অর্থাৎ মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকা , অস্তেয় অর্থাৎ চৌর্যবৃত্তি থেকে বিরত থাকা , অপরের দ্রব্য গ্রহণ না করা , ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ কাম সংক্রান্ত কর্ম বা চিন্তা থেকে বিরত থাকা । এবং অপরিগ্রহ অর্থাৎ প্রয়ােজনাতিরিক্ত কোন বিষয় গ্রহণ না করা ।
২ ) নিয়ম : শৌচ , সন্তোষ , তপস্যা , স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বর প্রাণিধান এই পাঁচটিকে যােগদর্শনে নিয়ম বলা হয়েছে । শৌচ অর্থাৎ পরিষ্কার পরিচ্ছন ও পবিত্র হওয়া । শৌচ দু’প্রকার বাহ্য ও অন্তর । স্ননাদি দ্বারা বাহ্য শৌচ এবং সৎচিন্তা , মৈত্রী , ইত্যাদি দ্বারা অন্তর শৌচ হয় । সন্তোষ অর্থাৎ সন্তুষ্ট হওয়া অল্পে তুষ্ট হওয়াই সন্তোষ । তপস্যা হল শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী ব্ৰতাচার অনুশীলন করা । স্বাধ্যায় অর্থাৎ শাস্ত্র যেমন বেদ , বেদান্ত, বেদাঙ্গ ইত্যাদির অধ্যায়ন । ঈশ্বর প্রণিধান বলতে ঈশ্বর চিন্তা বা ঈশ্বরে আত্মসমর্পণকে বােঝায় ।
৩ ) আসন : দেহ ও মনকে সুস্থ রাখা ও মনকে স্থির করে সাধনার উপযােগী করার জন্য যে অঙ্গভঙ্গী তাই আসন । অন্যভাবে বলা যায় , যে ভাবে শরীরকে রাখলে শরীরকে স্থির ও ক্লেশমুক্ত রাখা যায় তাই আসন । আসন বহু রকমের হতে পারে । যেমন— বিরাসন , পদ্মাসন , শীর্ষাসন , ভূজঙ্গাসন , বজ্ৰাসন , ইত্যাদি ।
৪ ) প্রাণায়াম : প্রাণায়াম শ্বাস প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করা । প্রাণায়াম তিন প্রকার রেচক , পূরক ও কুম্ভক । রেচক হল শ্বাস ত্যাগ করে স্থিত হওয়া । পূরক অর্থাৎ শ্বাস গ্রহণ করে স্থিত হওয়া এবং কুম্ভক হল শ্বাস ত্যাগ না করে দীর্ঘসময় শ্বাসকে ভিতরে ধরে রাখা ।
৫ ) প্রত্যাহার : ইন্দ্রিয়গুলিকে বাহ্য বিষয় থেকে সরিয়ে এনে অন্তর্মুখী করার নামই প্রত্যাহার । রূপ , রস , গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দের প্রতি যে স্বাভাবিক আকর্ষণ তা থেকে মনকে সরিয়ে এনে অন্তরের দিকে নিয়ে আনাই প্রত্যাহার ।
৬ ) ধারণা : চিত্ত সংযােগ করাই ধারণা । অভিপ্রেত কোন বস্তুর সাথে দীর্ঘ সময় মনােসংযােগ করাই ধারণা । ধারণার মাধ্যমে চিত্ত বা মনকে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে স্থির রাখা সম্ভব হয় ।
৭ ) ধ্যান : যে বিষয়ে চিত্ত নিবৃত্ত হয় সেই বিষয়ের নিরবচ্ছিন্ন ধারণা বা ভাবনাই ধ্যান । আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির ক্ষেত্রে ধ্যান আবশ্যক ।
৮ ) সমাধি : ধ্যানের পরিণাম হল সমাধি । সমাধিস্থ অবস্থায় যােগী নিজের সম্পর্কে, জগৎ সম্পর্কে এমন কি ধ্যান সম্পর্কেও কোন জ্ঞান থাকে না । চিত্তবৃত্তির নিরাধের জন্যই এই সমাধি ।