উত্তর : সাংখ্যদর্শনে মােক্ষ বা মুক্তিকে কৈবল্য বলা হয়েছে । সাংখ্য মতে ,ত্রিবিধ দুঃখের নিবৃত্তিই মােক্ষ বা মুক্তি। সাংখ্য মতে , দুঃখ তিন প্রকার — আধিভৌতিক ,আধি বৈদিক , আধ্যাত্মিক । এই ত্রিবিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিই মুক্তি বা মােক্ষ । শারীরিক ব্যাধি বা আঘাতজনিত কারণে যে দুঃখ উৎপন্ন হয় তাকে আধ্যাত্মিক দুঃখ বলে আধ্যাত্মিক দুঃখ দুই প্রকার শারীরিক এবং মানসিক । শারীরিক ব্যাধি বা আঘাতের কারণে উৎপন্ন যে দুঃখ তাকে শারীরিক দুঃখ এবং কাম , ক্রোধ ,ঈর্ষা ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন যে দুঃখ তাকে মানসিক দুঃখ বলে । মানুষ , পশু , কীট ইত্যাদি কারণে জীবকে যে দুঃখ ভােগ করতে হয় তাকে আধিভৌতিক দুঃখ এবং অপ্রাকৃত কারণ থেকে উৎপন্ন দুঃখকে আধিদৈবিক দুঃখ বলে । যেমন— ভূত , প্রেত ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন দুঃখই আধিবৈদিক দুঃখ ।
দুঃখ নিবৃত্তির ক্ষেত্রে দুটি উপায়ের কথা বলা হয়েছে । লৌকিক বা দৃষ্ট উপায় এবং বৈদিক বা অদৃষ্ট উপায় । লৌকিক বা দৃষ্ট উপায়ে ঔষধাদি ব্যবহার দ্বারা দুঃখ নিবৃত্তি হয় । আবার , যজ্ঞাদি ক্রিয়া কর্মের দ্বারা স্বর্গলাভ দ্বারা দুঃখ নিবৃত্তি হয় না । কারণ , ঔষাদি ব্যবহার দ্বারা দুঃখ নিবৃত্তি সাময়িকভাবে হয় । যেহেতু , পরবর্তীকালে পুনরায় অনুরূপ দুঃখের আবির্ভাবের সম্ভাবনা থেকে যায় । তেমনি বৈদিক ক্রিয়াকর্মের ফলে স্বর্গলাভ হলে দুঃখের নিবৃত্তি হয় ঠিকই । কিন্তু ঐ ফলভােগ শেষ হলে পুনরায় সংসারে জন্মগ্রহণ করে দুঃখ ভােগ করতে হয় । ফলে লৌকিক এবং বৈদিক এই দুটি উপায়ের কোনােটির দ্বারাই দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয় না ।
সাংখ্য দর্শনে বলা হয়েছে , ‘জ্ঞানাৎ মুক্তি’ । অর্থাৎ জ্ঞান দ্বারাই দুঃখের আত্যন্তিক আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয় না । জ্ঞান বলতে তত্ত্বজ্ঞানকেই বােঝায় ।
কিন্তু লৌকিক এবং বৈদিক দুটি উপায়ের কোনটির দ্বারাই দুঃখের কিন্তুঐ ফলভােগ শেষ হলে পুনরায় সংসারে জন্মগ্রহণ করে দুঃখ ভােগ করতে হয় । সাংখ্য দর্শনে ‘ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞ বিজ্ঞানাৎ’কে তত্ত্বজ্ঞান বলা হয়েছে । ব্যক্ত অর্থাৎ ব্যক্ত প্রকৃতি বা জগৎ , অব্যক্ত অর্থাৎ প্রকৃতির স্বরূপ । এবং ‘জ্ঞ’ অর্থাৎ পুরুষ । কাজেই ,প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন যাবতীয় প্রকৃতির জ্ঞান পার্থিব বস্তু এবং জ্ঞ বা পুরুষ বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান । সাংখ্যমতে , এই তিনটি বিষয়ের জ্ঞান হলেই পুরুষ ও প্রকৃতির মধ্যে ভেদ জ্ঞান উৎপন্ন হয় । আর , পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদজ্ঞান দ্বারাই যাবতীয় দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয় । সাংখ্য দর্শনে একে শাস্ত্রীয় উপায় বা আনুশ্রবিক উপায় বলা হয়েছে ।
অবিবেক বা অবিদ্যাবশতঃ পুরুষ প্রকৃতির সংস্পর্শে আসার পর পুরুষ প্রকৃতির ধর্মগুলিকে নিজের মনে করে যাবতীয় দুঃখ ভােগ করে । অবিবেকবশতঃই পুরুষ দেহ , ইন্দ্রিয় , মন ইত্যাদির সাথে নিজেকে অভিন্ন মনে করে । এটিই জীবের বন্ধন । কাজেই , অবিবেকই পুরুষের বন্ধনের কারণ । কাজেই বিবেক জ্ঞান দ্বারা পুরুষ ও প্রকৃতির সংযােগের উচ্ছেদই মুক্তি । এটিকে সাংখ্যে সুখের অবস্থা বলা হয়নি । মুক্তি বা মােক্ষ হল দুঃখের আত্যন্তিক ও ঐকান্তিক নিবৃত্তি ।
সাংখ্য মতে , পুরুষ নিত্য, শুদ্ধ , বুদ্ধ ও মুক্ত স্বভাব সম্পন্ন হলেও অবিবেকবশতঃ দেহ , ইন্দ্রিয়, মনের সাথে নিজেকে অভিন্ন বলে মনে করে যাবতীয় দুঃখ ভােগ করাই হল পুরুষের বন্ধন । আর বিবেক জ্ঞান প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদজ্ঞান দ্বারা উভয়ের সংযােগের বিনাশই হল মােক্ষ বা মুক্তি । আত্মা বা পুরুষ তত্ত্বজ্ঞান লাভের পর যতদিন জীবিত অবস্থায় থাকে সেই অবস্থাকে জীবন্মুক্ত অবস্থা বলে । আর , জীবন্মুক্তি ব্যক্তির দেহবিনাশের পর যে মুক্ত অবস্থা তা হল বিদেহ মুক্তি ।