উত্তর : ন্যায়দর্শনে প্রত্যক্ষের লক্ষণে ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষকে প্রত্যক্ষের কারণ বলা হয়েছে । সন্নিকর্ষ একপ্রকার সম্বন্ধ, যা ইন্দ্রিয়ের সাথে বিষয়ের মধ্যেই হয়ে থাকে । তবে , যে কোনাে ইন্দ্রিয়ের সাথে যে কোন বিষয়ের সম্বন্ধ সন্নিকর্ষ নয় । সে ইন্দ্রিয় যে বিষয়ের গ্রাহক কেবলমাত্র সেই ইন্দ্রিয়ের সাথে ওই বিষয়ের সম্বন্ধই সন্নিকর্ষ, যার অব্যবহিত পরক্ষণে প্রত্যক্ষ উৎপন্ন হয় । একটি প্রত্যক্ষ গ্রাহ্য বিষয় এবং ত্বক একটি ইন্দ্রিয় । ত্বক দ্বারা বর্ণস্পর্শ করার সময় ইন্দ্রিয় এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় বা অর্থের মধ্যে সম্বন্ধ হয় । সম্বন্ধকে সন্নিকর্ষ বলা যাবে না । কারণ , এক্ষেত্রে সম্বন্ধ থেকে কোনাে জ্ঞান উৎপন্ন হয় না । কিন্তু সন্নিকর্ষের ক্ষেত্রে জ্ঞান উৎপন্ন হয় । এই জন্য ন্যায়দর্শনে বলতে সেই ইন্দ্রিয় এবং সেই অর্থ ( বিষয় ) -এর সম্বন্ধকেই বােঝানাে হয়েছে যার অব্যবহিত পরক্ষণে ঘটের জ্ঞান উৎপন্ন হয় । যেমন— ঘট ( বিষয়ের ) সাথে চক্ষু ( ইন্দ্রিয়ের )সংযােগ সম্বন্ধ থেকে ঘটের জ্ঞান উৎপন্ন হয় । এইজন্য ন্যায়দর্শনে সন্নিকর্ষ বলতে বােঝায়, যে ইন্দ্রিয়ের যে বিষয়ের গ্রাহক সেই সাথে সেই ইন্দ্রিয়ের সাথে সেই বিষয়ের সন্নিকৃষ্ট রূপ বৃত্তি বা ব্যাপার যার অব্যবহিত পরক্ষণে জ্ঞান উৎপন্ন হয় । ন্যায়দর্শনে লৌকিক এবং অলৌকিক নামে দু’প্রকার প্রত্যক্ষ মানা হয়েছে ।লৌকিক প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে লৌকিক সন্নিকর্ষকে আর অলৌকিক প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে অলৌকিক সন্নিকর্ষকে কারণ বলা হয়েছে । লৌকিক সন্নিকর্ষ আবার ছয় প্রকার । যথা— ( ১ ) সংযােগ সন্নিকর্ষ ( ২ ) সংযুক্ত - সমবায় সন্নিকর্ষ ( ৩ ) সংযুক্ত সমবেত - সমবায় সন্নিকর্ষ (৪ ) সমবায় সন্নিকর্ষ ( ৫ ) সমবেত - সমবায় সন্নিকর্ষ এবং ( ৬ ) বিশেষ্য - বিশেষণভাব সন্নিকর্ষ ।
( ১ ) সংযােগ সন্নিকর্ষ : চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সাথে ঘটবিষয়ের প্রত্যক্ষ জ্ঞান উৎপত্তির ক্ষেত্রে যে সন্নিকর্ষ হয় তাই সংযােগ সন্নিকর্ষ । এক্ষেত্রে চক্ষু ইন্দ্রিয় এবং ঘট হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় বা অর্থ । ন্যায় মতে , দুটি যুতসিদ্ধ অর্থাৎ বিচ্ছেদ্য দ্রব্যের মধ্যে যদি সম্বন্ধ হয় তাহলে সেই সম্বন্ধ হবে সংযােগ সন্নিকর্ষ । এক্ষেত্রে দ্রব্য দুটির মধ্যে কখনােই অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ থাকবে না । যেমন — অবয়ব অবয়বী , গুণগুণী এই সম্বন্ধগুলি অবিচ্ছেদ্য বলে এই দুটির সম্বন্ধ সংযােগ নয় । কাজেই , যে দুটি বিষয়ের মধ্যে সংযােগ সম্বন্ধ হয় তার সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযােগ সন্নিকর্ষ হয় । চক্ষু ও ঘটের মধ্যে সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য নয় । তাই চক্ষু ( ইন্দ্রয় ) দ্বারা ঘট ( বিষয়ের ) প্রত্যক্ষ স্থলে যে সন্নিকর্ষ কারণ হয় তাই সংযােগ সন্নিকর্ষ ।
( ২ ) সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ : যে পদার্থের সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযােগ সন্নিকর্ষ হয় সেই পদার্থে যা সমবেত হয় বা সমবায় সম্বন্ধে থাকে , সেই সমবায় সম্বন্ধে থাকা বিষয়টির প্রত্যক্ষ স্থল যে সন্নিকর্ষ হয় তাই সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ । যেমন — ঘটের রূপ বা বর্ণ ঘটে সমবায় সম্বন্ধ থাকে । ঘটের সাথে চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সংযোেগ সম্বন্ধ হয় । ফলে , সংযােগ সম্বন্ধে থাকা থাকে ঘটের বর্ণ বা রূপ প্রত্যক্ষ স্থলে যে সন্নিকর্ষ কারণ হয় তাই সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ ।
( ৩ ) সংযুক্ত সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ : যে ইন্দ্রিয়ের সাথে যে বিষয়ের সংযুক্ত সমবায় সন্নিকর্ষ হয় সেই সমবেত বিষয়টির প্রত্যক্ষ স্থলে যে সন্নিকর্ষ হয় তাই সংযুক্ত সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ । যেমন – চক্ষু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ঘটের রূপ বা বর্ণের বর্ণত্ব জাতি বা সামান্য প্রত্যক্ষ স্থলে যে সন্নিকর্ষ কারণ হয় তাই সংযুক্ত সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ । যেমন— ঘটরূপের রূপত্ব জাতি । রূপত্ব জাতি রূপে সমবেত অর্থাৎ সমবায় সম্বন্ধে থাকে । আবার , রূপের সাথে ঘটের সম্বন্ধ হল সমবায় । আর , চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সাথে ঘট - এর সম্বন্ধ হল সংযােগ ।
( ৪ ) সমবায় সন্নিকর্ষ : শব্দ কর্ণেন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষের বিষয় । তাই , শব্দ প্রত্যক্ষ স্থলে কর্ণ ইন্দ্রিয়ের সাথে শব্দ বিষয়ের সন্নিকর্ষ হয় । এই সন্নিকর্ষই ন্যায় মতে সমবায় সন্নিকর্ষ ।
( ৫ ) সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ : যে বিষয়ের প্রত্যক্ষ স্থলে সমবায় সন্নিকর্ষ হয় সেই বিষয়ে যা সমবেত হয় বা সমবায় সম্বন্ধে থাকে সেই সমবেত পদার্থটির প্রত্যক্ষ স্থলে যে সন্নিকর্ষ হয় তাই সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ । যেমন — শব্দ প্রত্যক্ষ স্থলে সমবায় , সন্নিকর্ষ হয় । শব্দে শব্দত্ব জাতি সমবায় সম্বন্ধে থাকে বলে দিত্ব জাতি শব্দে সমবেত । কাজেই , শব্দত্ব জাতির প্রত্যক্ষ স্থলে যে সন্নিকর্ষ হয় তাই সমবেত সমবায় সন্নিকর্ষ ।
( ৬ ) বিশেষণ বিশেষ্যভাব সন্নিকর্ষ : ন্যায় মতে বিশেষণ বিশেষ্য ভাব সন্নিকর্ষ হয় অভাবের প্রত্যক্ষ স্থলে । যেমন —ভূতলে ঘট নেই । অর্থাৎ ভূতলটি ঘটাভাব বিশিষ্ট । এইরূপ অভাবের প্রত্যক্ষ স্থলে ‘ভূতল’ হল বিশেষ্য এবং ঘটাভাব হল বিশেষণ এরূপ বিশেষণ বিশেষ্যভাব সম্বন্ধ প্রত্যক্ষ স্থলে যে সন্নিকর্ষ কারণ হয় ন্যায়দর্শনে তাকেই বিশেষণ বিশেষ্যভাব সন্নিকর্ষ বলে ।