উত্তর :শুরুর কথা : “ঠিক যাকে সাধারণে ধর্ম বলে , সেটা যে আমি আমার নিজের মধ্যে সুস্পষ্ট দৃঢ়রূপে লাভ করতে পেরেছি , তা বলতে পারিনে । কিন্তু মনের ভিতরে ভিতরে ক্রমশঃ যে একটা সজীব পদার্থ সৃষ্টহ য়ে উঠেছে , তা আমি অনেক সময় অনুভব করতে পারি , বিশেষ কোনাে একটা নির্দিষ্ট মত নয় — একটা নিগূঢ় চেতনা , একটা নতুন অন্তরিন্দ্রিয় ।”
রবীন্দ্রনাথের নিজের এই স্বীকারােক্তি থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে, তিনি কোনাে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতে বিশ্বাসী ছিলেন না । প্রথম জীবনে নিজের পারিবারিক ধর্ম অর্থাৎ ব্রাত্মধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করলেও পরবর্তীকালে তিনি অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে , সেটা ছিল তার ভ্রান্তি । তাঁর মনে হয়েছিল যে , ধর্মকে অবলম্বন করতে গিয়ে তিনি আসলে বিশেষ একটি ধর্মমতকে প্রশ্রয় দিয়ে চলছিলেন । তার পরিণত চিন্তা তাঁকে এই উপলব্ধি এনে দিল যে, “আমরা বাইরের শাস্ত্র থেকে যে ধর্ম পাই সে কখনােই আমার ধর্ম হয়ে ওঠে না — তার সঙ্গে কেবলমাত্র অভ্যাসের যােগ জন্মে ।
গোঁড়ামি : রবীন্দ্রনাথ ‘ধর্ম’ বলতে ঠিক কি বুঝিয়েছিলেন ? তাঁর নিজস্ব ধর্মভাবনার স্বরূপ ? প্রথমেই বলা দরকার যে ধর্মের গোঁড়ামি তাকে আঘাত করেছিল । ধর্ম যে কেবল কতকগুলি নীরস , শুষ্ক , প্রাণহীন আচরণরীতি নয়, তা তিনি মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করেছিলেন বলেই নিজের পারিবারিক ধর্মকে পরিত্যাগ করতেও দ্বিধান্বিত হননি । তিনি এক চিঠিতে লিখেছেন — “শান্তিনিকেতনে ১১ই মাঘের উৎসব করতে আমার একটুও সংকোচ বােধ হয় না । কিন্তু আমাদের বাড়িতে অর্থহীন অনুষ্ঠানের আড়ম্বর আমাকে বড় লজ্জা দেয় ।” ধর্মকে পুথির উপর নির্ভরশীল করতে , কাল্পনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে তার মন সায় দেয়নি । তিনি চেয়েছিলেন ধর্মকে মানুষের অস্তিত্বের মূলে স্থাপন করতে । মানুষের জীবনের অন্তর ও বাহির তাঁর কল্পনায় রূপ পেয়েছে । একদিকে জীবন চর্যা ; অন্যদিকে আধ্যাত্মচেতনা — এ দুটিকেই তিনি ধর্মের মূল বলেছেন । “মানুষের আধ্যাত্মচেতনা তার শ্রেষ্ঠ ধর্ম ।”
স্বতন্ত্র চেতনা : সুতরাং ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা প্রচলিত বিশ্বাস ও মতামতের থেকে স্বতন্ত্র এবং অনেক ক্ষেত্রে যে বিরােধী হবে তা সহজেই অনুমেয় । তাঁর মতে , “মানুষের মধ্যে যে গঢ় সত্য আছে তা সমস্ত স্থানিক বা কালিক সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করে সার্বিক মূর্তি পরিগ্রহ করে । কিন্তু ধর্মের আর একদিকে যে জীবনচর্যা আছে তা বিচিত্র, জটিল । চরম সত্য সম্পর্কে সব ধর্মই প্রায় একই কথা বলে । কিন্তু ধর্মের যে রূপটি জীবনের মধ্যে প্রকাশিত সেখানে মানুষের চিন্তার, কর্মের বিরােধের কোনাে সীমা নেই ।” তিনি একটি চিঠিতে লিখেছেন — আমরা ধর্মকে আমাদের নিজেদের চেয়ে নেমে যেতে দিয়েছি , আমরা কেবল বলছি — আমরা নিকৃষ্ট অধিকারী , আমরা পারিনি । বিশুদ্ধ সত্য , বিশুদ্ধ মঙ্গল আমাদের জন্য নয়, অতএব আমাদের পক্ষে এইসব মুগ্ধ কল্পনাই ভালাে ।
সকল মানুষেরই ‘আমার ধর্ম’ বলে একটা বিশেষ জিনিস আছে । কিন্তু সেইটিকেই সে স্পষ্ট করে জানে না । সে জানে আমি খৃষ্টান,আমি মুসলমান , আমি বৈষুব , আমি শাক্ত ইত্যাদি । কিন্তু সে নিজেকে যে ধর্মাবলম্বী বলে জন্মকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত নিশ্চিন্ত আছে সে হয়ত সত্য তা নয় । নাম গ্রহণেই এমন একটা আড়াল তৈরি করে দেয় যাতে নিজের ভিতরকার ধর্মটা তার নিজের চোখেও পড়ে না । কোন্ ধর্মটি তার ? যে ধর্ম মনের ভিতরে গােপনে থেকে তাকে সৃষ্টি করে তুলছে ।
ধর্মবিশ্বজনীন : রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে , ধর্ম এক বিশ্বজনীন বিষয় । ধর্মকে তাই কোনাে সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে তার মন সায় দেয়নি । আধুনিক পৃথিবীতে সেই পুরাতন ধর্মের সহিত নতুন বােধের বিরােধ খুবই প্রবল হইয়া উঠিয়াছে । সে এমন একটি ধর্মকে চাহিতেছে যাহা কোনাে একটি বিশেষ জাতির , বিশেষ কালের ধর্ম নহে , যাহাকে কতকগুলি বাহ্য পুজাপদ্ধতি দ্বারা বিশেষ রূপের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া ফেলা হয় নাই , মানুষের চিত্ত যতদূরই প্রসারিত হােক , যে ধর্ম কোনােদিকেই তাহাকে বাধা দিবে না ,বরং সকল দিকেই তাহাকে মহানের দিকে অগ্রসর হইতে আহ্বান করিবে । মানুষের জ্ঞান তারা যে ভূমিক্ষেত্রে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে সেইখানের উপযােগী হৃদয়বােধকে ও ধর্মকে না পাইলে তাহার জীবন সংগীত সুর মিলিবে না এবং কেবল তাল কাটিয়া থাকিবে ।”
মূল্যায়ন : তাহলে দেখা যাচ্ছে , রবীন্দ্রনাথ ধর্মকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোনাে বিষয় বলে মনে করেননি । বাইরে থেকে যা দেখা যাচ্ছে তা তার মতে , সাম্প্রদায়িক ধর্ম । তাই তিনি বলেন “আমার ধর্ম আমার — জীবনেরই মূলে” । ধর্ম যে কতকগুলাে আচরণবিধি নয়, ধর্ম যে নিছক ঈশ্বর ভক্তি নয় — এ বিষয়ে তিনি দৃঢ়বিশ্বাসী ছিলেন , কতকগুলাে নিয়মনিষ্ঠ কর্ম সম্পাদনই ধর্মের শেষ কথা নয় । তাছাড়া , ধর্ম কোনাে নিষ্প্রাণ শুষ্ক বিষয় নয় ।রবীন্দ্রনাথের ধর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র তাই ঈশ্বর না হয়ে মানুষ হয়েছে । তিনি তাই তার ধর্মকে ‘মানবধর্ম’ বলে অভিহিত করেছেন ।