উত্তর : রবীন্দ্রভাবনা : “The Religion of Man” গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়টি হল ‘মানুষের প্রকৃতি’ । এই অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যে নিত্য মানবের অধিষ্ঠানের কথা বলেছেন । নিত্য মানবের সঙ্গে ব্যক্তিমানবের ঐক্যের বিষয়টি অনুভব করা মানবসভ্যতার নিদর্শন । মানুষ তার ধর্মের মধ্য দিয়েই এই পরম মানব বা সর্বজনীন মানবের উপস্থিতি অনুভব করে । মানুষের মধ্য দিয়ে যে রহস্যময় সত্তার ঐক্য তার সমাজে প্রকাশিত হয়, সে সম্পর্কে সচেতনতা তার নিজের সত্তার যথার্থ সচেতনতা থেকেই । ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্কের এই সূক্ষ্ম মাধ্যমটি কিন্তু নিছক প্রয়ােজনের জন্য গড়ে ওঠেনি , বরং এর মধ্য দিয়েই তার চরম সত্যটি প্রকাশিত হয়েছিল । এটিকে গণিতের অঙ্ক হিসেবে না দেখে জীবনের মূল্য হিসেবেই গণ্য করতে হবে । অখণ্ড সত্তার সঙ্গে মানুষের এই যে ঐক্য , তার একটা ঐশ্বরিক চরিত্র আছে । কেননা এটি সব মানুষকে তার ব্যক্তিগত যাবতীয় বিষয় বিসর্জনের আহ্বান জানায় । আর এই ত্যাগের মধ্য দিয়েই সে তার সীমাবদ্ধ সত্তাকে অতিক্রম করতে পারে । সত্তার এই ঐক্যের প্রতি মানুষের যে সশ্রদ্ধ বিশ্বাস রয়েছে তারই প্রতিফলন ঘটে তার ধর্মের মধ্যে । বিভিন্ন দেবদেবীর রূপের মধ্যেই তা প্রতীকায়িত হয় । প্রাথমিক পর্বে তার দেবতা ছিল উপজাতীয় দেবতা , বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দেবতাও একই উপজাতির অন্তর্গত ছিল । মানবিক ঐক্য চেতনার বিস্তৃতির ফলে তার দেবতা তার কাছে এক ও সর্বজনীন রূপেই আবির্ভূত হল । এটি প্রমাণ করে যে , মানবিক ঐক্যের সত্য আসলে মানুষের দেবতারই সত্য ।
নরদেবতারে : রবীন্দ্র জীবনের বেশ কিছু বছর কেটেছে মানুষ সম্পর্কে চিন্তাভাবনায় । তিনি চেয়েছিলেন এই মানুষকে পূর্ণ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে । ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় তিনি বলেছিলেন —
“হেথায় দাঁড়ায়ে দুবাহু বাড়ায়ে নমি নর দেবতারে
উদার ছন্দে পরমানন্দে বন্দন করি তরে ।”
নরই ছিল তাঁর কাছে নারায়ণ , জীবই শিব । যে মানুষকে তিনি ঈশ্বরের সমান আসন দিতে চেয়েছিলেন সেই মানুষ কোনাে গােষ্ঠিভুক্ত বা সম্প্রদায়গত বা বিশেষ ধর্মগত মানুষ নয় । তাই তিনি এই মানুষের দিয়েছিলেন ‘চিরমানব’ ‘পরমমানব’ বা ‘মহামানব’ । এই মহামানবকে আবার তিনি ‘মানবব্ৰত্ম’ বলেও অভিহিত করেছেন । রবীন্দ্রনাথের ‘ধর্ম’ তাই কোনাে নির্দিষ্ট কালের ও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিশেষ সম্পত্তি নয় , তা সর্বকালের সর্বমানবের সম্পদ ।
ব্যক্তিমানব : রবীন্দ্রনাথ ‘প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করেছেন , কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বৃহৎ মানব সমাজে তাকে এক বলেই গ্রহণ করেছিলেন । কোনাে মানুষকে মানব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না — মানব সমাজের সঙ্গে তার জীবন অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত । বিশ্বমানবের বৃহৎ পরিবেশেই মানুষের অস্তিত্ব । বিশ্বমনের সঙ্গে ব্যক্তি মনের একটি ঐক্য রয়েছে ।’ একদিকে প্রত্যেক মানুষের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা বিশেষত্ব , অন্যদিকে রয়েছে বিশ্বের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যােগসূত্র ।
ধর্মসাধনা যে মানুষেরই জীবন সাধনা — এই উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তার মধ্যে উপস্থিত ছিল । সাধনাকে মানুষের দিক থেকে সরিয়ে এনে যদি অন্য কিছুর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয় তাহলে তা মানুষের ধর্ম হবে না । মানুষকে বাদ দিয়ে যে সাধনা তাকে রবীন্দ্রনাথ কখনাে স্বীকার করেননি । ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে এবিষয়ে সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেছেন ।
আপন হতে : মানুষের নিজের মধ্যেই যে মানুষ লুকিয়ে রয়েছে তাকে খুঁজে পাওয়াই মানুষের ধর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া । এর সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –
আপন হতে বাহির হয়ে বাহিরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলােকের পাবি সাড়া ।
মনের মানুষ মনের মাঝে করাে অন্বেষণ । এই অন্বেষণ আজও চলেছে । এই মানুষের স্বরূপ এখনও অধরা থেকে গেলেও মানুষ তার অন্বেষণ থেকে দূরে সরে যায়নি , বরং সেই মানুষটির ডাকে সে সবকিছুকে অগ্রাহ্য করেছে । তার জাগতিক সবকিছুকে উপেক্ষা করেছে । কোনাে কিছুই তার চলার পথে প্রাচীর তুলে দিতে পারেনি । যার ডাকে দূর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে চায় মন , যাকে কোনােমতেই অস্বীকার করা যায় না , কি তার পরিচয় ? রবীন্দ্রনাথ এই প্রশ্নেরউত্তর দিয়েছেন এইভাবে –
“কে সে । জানিনা কে । চিনি তাই তারে ।
শুধু এইটুকু জানি , তারি লাগি রাত্রি — অন্ধকারে চলেছে মানব যাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে ।”
মূল্যায়ন : মানবধর্ম বা মানুষের ধর্মের স্বরূপ তিনি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন তার ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থের ভূমিকায় । তিনি বলেছেন — “স্বার্থ আমাদের যেসব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি জীব প্রকৃতিতে , যা আমাদের ত্যাগের দিকে তপস্যার দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব , মানুষের ধর্ম ।” মানুষের আত্ম উপলব্ধি বাইরে থেকে অন্তরের দিকে গেছে । এই অন্তর হল তার বিশ্বমানবলােক । এই অন্তরের বােধ সকল ভেদ ছাড়িয়ে ঐক্যের দিকে প্রসারিত ।