‘পরােপকারে আমরা নিজেদেরই উপকার করি ’ – এই বিষয়ে বিবেকানন্দের ভাবনা কী ?

অনাস পাস দর্শন honours pass general philosophy questions answers প্রশ্নোত্তর পরােপকারে আমরা নিজেদেরই উপকার করি  এই বিষয়ে বিবেকানন্দের ভাবনা কী propokare amra nijederei upokar kori ai bishoye bibekanonder vabna ki questions answers


উত্তর :  আনুষ্ঠান ভিত্তিক : বিবেকানন্দ বলেন যে , প্রতিটি ধর্মের দর্শন, পুরাণ ও অনুষ্ঠান— এই তিনটি অংশ আমরা দেখতে পাই । দর্শনে ধর্মের মূলে বক্তব্যটি ধরা থাকে , পুরাণ — অংশে থাকে ধর্মের ব্যাখ্যা এবং অনুষ্ঠান দর্শনকে বাস্তব রূপ দেয় । ধর্মের ভাব বােঝা কঠিন ,ধর্মের চিন্তা নাই বিভিন্ন প্রতীকের সাহায্যে সাধারণের মধ্যে প্রচলিত হয় । ভাষাও প্রতীক যে কোনাে ভাষায় শব্দ চিন্তার প্রতীক হিসাবেই ব্যবহৃত । এই প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ বলেন — ‘এইসব প্রতীক শুধু প্রথা মাত্র হতে পারে না । নিশ্চয় এর কোনাে কারণ আছে , তাদের সঙ্গে মানবমনের কোনাে স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে , ভাষা প্রথার ফলে উৎপন্ন নয় ..... ” 


ভাষায় এই শক্তিকে জানা এবং সেই শক্তিকে ঠিকমতাে ব্যবহার করাও কর্মযােগের একটি অংশ বলে বিবেকানন্দ মনে করেন । এই শক্তি দিয়ে আমরা কী ধরনের কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করব ? তিনি বলেন “অন্যদের প্রতি আমাদের কর্তব্যের অর্থ হল , আমাদের সাহায্য করা , জ্ঞাতের কল্যাণ করা , কেন জগতের ভালাে করব ? জগতের উপকার করার জন্য , কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিজেদের উপকারের জন্য , আমাদের সর্বদা পৃথিবীকে সাহায্য করা উচিত , সেটাই আমাদের মহত্তম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত । কিন্তু ভালাে করে চিন্তা করলে দেখব যে ,পৃথিবীর আমাদের সাহায্যের প্রয়ােজন আদৌ নেই । আমি তুমি সাহায্য করব বলে এই জগৎ তৈরি হয়নি ।” 


বাস্তবের আঙিনায় : আমাদের সাহায্যের প্রয়ােজন জগতের না থাকলেও আমরা অন্যের কল্যাণ করার চেষ্টা করে যাবাে । কীভাবে অন্যের কল্যাণ করব ? হাসপাতাল , রাস্তা বা দাতব্যালয় তৈরি করব ? বিবেকানন্দ বলেন - “একটা ঝড় পাঁচ মিনিটে তােমার সব বাড়ি ভেঙে ফেলতে পারে ।আগ্নেয়গিরির একটি বিস্ফোরণে আমাদের সব রাস্তা, হাসপাতাল , শহর , বাড়ী শেষ হয়ে যেতে পারে । জগতের কল্যাণ করার এসব অবান্তর কথা আমাদের ভুলতে হবে । জগৎ আমার বা তােমাদের সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছে না, তবু আমাদের অবিরাম কল্যাণ কাজ করে যেতে হবে , কারণ ,আমাদের পক্ষে তা আশীর্বাদ স্বরূপ । একমাত্র এইভাবেই আমরা সার্থক হতে পারি । যেসব ভিক্ষুককে আমরা ভিক্ষা দিয়েছি , তারা কেউ কোনদিন আমাদের কাছে এক কপর্দকও ঋণী নয়, আমরা তাদের কাছে সর্বদা ঋণী , কারণ তারা আমাদের দানব্রত আচরণের সুযােগ দিয়েছে ।মানুষকে সাহায্য করার মাধ্যমে ঈশ্বরপূজা করতে পারা কি একটা বিরাট সুযােগ নয় ?” 

বিবেকানন্দের বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করা যায় —হাসপাতাল ভেঙে যেতে পারে বলে হাসপাতাল করব না ? সে ভিখারীকে ভিক্ষা দেব সেও তাে ভিক্ষাগ্রহণের পরমুহূর্তেই মারা যেতে পারে । তাছাড়া , আমাদের দানব্রত করার সুযােগ দেওয়ার জন্য ভিখারী থাকবে ? এমন সমাজ পরিবর্তনের কথা কি তিনি ভাবতে পারেন না যেখানে ভিখারীই থাকবে না ? এসব প্রশ্নের কোনাে সঙ্গত উত্তর সঙ্কেত কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি না । 


উদারচেতা : নির্লিপ্তির মাধ্যমে কর্মসাধনায় লিপ্ত হলে ধর্মের নামে উন্মত্ততা আসবে না । বিবেকানন্দ তাই অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেন “ জগতে ধর্মোন্নত্ততা না থাকলে অনেক বেশি উন্নত হত , ধর্মোন্নত্ততা মানবজাতির উন্নতি ঘটাতে পারে , একথা ভাবা ভুল । বরং এতে ঘণা ও ক্রোধের সৃষ্টি হয়ে উন্নতির বাধা ঘটে , লােকে পরস্পর ঝগড়া করে , তাদের সহানুভূতি নষ্ট হয়ে যায়, ধর্মান্মত্তরতা এড়াতে পারলে ভালাে করে কাজ করতে পারবে । যে স্থিতধী , শান্ত, ন্যায়নিষ্ঠ ও স্থিরমস্তিষ্ক, যার গভীর সহানুভূতি ও ভালােবাসা রয়েছে , সে সৎকাজ করে নিজের কল্যাণ করে । ধর্মোন্মাদ, মূর্খ, যার সহানুভূতি নেই , সে কখনাে জগৎকে বদলাতে পারে না , নিজেও পবিত্র ও সম্পূর্ণ হতে পারে না,” । বিবেকানন্দ উপসংহারে বলেন – “প্রথমত , মনে রাখতে হবে , আমরা সবাই জগতের কাছে ঋণী , জগৎ আমাদের কাছে ঋণী নয় , জগৎকে সাহায্য করে আমরা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের সাহায্য করি । দ্বিতীয়ত, একথা ঠিক নয় যে, জগতের কাছে তােমার , আমার সাহায্যের প্রয়ােজন আছে । ঈশ্বর বিশ্বে সর্বদা বর্তমান , তিনি অত্যন্ত চিরকর্মী চিরজাগ্রত , জগতের সব পরিবর্তন ও রূপ তারই লীলা । তৃতীয়ত ,কাউকে ঘৃণা করা উচিত নয় । আমাদের কর্তব্য হল ,দুর্বলের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ হওয়া এবং পাপীকেও ভালবাসা । চতুর্থত, কোনােরকম উন্মত্ততা থাকা উচিত নয় , উন্মত্ততা প্রেমের বিপরীত , শুনতে পাই এরকম লােকেরা বলে , ‘আমি পাপীকে ঘৃণা করি না ; পাপকে ঘৃণা করি । কিন্তু পাপ আর পাপীর মধ্যে যথার্থ বিভেদ করতে পারে এরকম লােকের দেখার জন্য যেকোনাে জায়গায় যেতে আমি রাজী আছি , ওরকম বলা সহজ । গুণ আর বস্তুর মধ্যে সত্যি বিভেদ করতে পারলে আমরা সম্পূর্ণ মানুষ হতাম । এ কাজ করা সহজ নয়, শেষত , আমরা যত শান্ত হবাে , তত কাজ ভালােবাসতে পারব ,আমাদের কাজ তত ভালাে হবে ।”



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন