উত্তর : ধর্ম ও রাধাকৃষ্ণাণ : রাধাকৃষ্ণাণ তাঁর জীবনে ধর্ম সম্পর্কে অনেকগুলি ভাষণ দিয়েছিলেন । আর সেই সমস্ত ভাষণগুলি আমরা তৎকালীন ধর্ম আর দর্শন সম্পর্কে সমাজের মনােভাব বুঝতে পারি । রাধাকৃষ্ণাণ কোনােদিনও ধর্মকে জড়বস্তু ভাবতে পারেননি । তিনি কোনাে দিন ভাবেননি ধর্ম একটা নিশ্চল বস্তু বিশেষ । তিনি জানতেন ধর্ম একটি চলমান পদার্থ । জীবন্ত যেকোনাে কিছুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রাণশক্তির নতুন প্রয়াস হল ধর্ম । এই ধর্মই আমাদের কোনাে কিছুর প্রতি প্রত্যেকটা মুহূর্তে আগ্রহী আর শ্রদ্ধাশীল করে তােলে । সেই কারণেই আমরা মেতে উঠি নতুন কিছু সৃষ্টি করার আনন্দে । আমরা নিজেদেরকে নিয়ােগ করি নতুন প্রজনন শক্তির ক্ষেত্রে । আর তারপরে একান্ত উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করি কবে সেই নতুন জীবন আসবে পৃথিবীর বুকে । আমরা সকলে ব্যাকুল হয়ে উঠি পরমাত্মিক সত্তার গােপন ভাণ্ডার থেকে অমূল্য রত্নরাজিকে তুলে আনার জন্য ।
আমাদের অন্তরের দৃষ্টি মেলতে আমাদের সাহায্য করে ধর্ম । আমরা প্রতিদিন সাধারণভাবে যে যে জিনিসগুলি চোখের সামনে দেখতে পাই না, সেই সমস্ত জিনিসগুলাে আমাদের দেখতে সাহায্য করে এই ধর্মহ , আর সেগুলি দেখার পরেই আমরা সত্য সম্পর্কে আরাে বেশি আগ্রহী আর শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ি । আমরা সকলে বুঝতে পারি আমাদের কি কারণে কোন্ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য এই পৃথিবীতে আসতে হয়েছে ।
রাধাকৃষ্ণাণ কিন্তু বারবার সশ্রদ্ধ অবনত চিত্তে স্মরণ করেছিলেন বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী বার্গাসকে । কারণ বার্গাস আমাদের সকলের সামনে পৃথিবীতে প্রাণের ক্রম বিকাশবাদের একটা আধুনিক ব্যাখ্যা মেলে ধরেছেন । বার্গাস নিজে বিশ্বাস করতেন যে , প্রত্যেক মানুষের মনের জ্ঞানের সাথে তার বাস্তব বিচারবােধের একটি সুসংগত সম্মিলন ঘটিয়ে দিতে হবে । যদি আমরা এ মিশনটাকে সঠিকভাবে করতে পারি তাহলেই আমরা চরম আত্মতৃপ্তি লাভ করতে সক্ষম হব ।
আধ্যাত্মিক জীবন : রাধাকৃষ্ণাণ মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে আত্মিক জীবনের তুলনা করে বারবার নানা ভাষণ দিয়েছেন । তিনি নানা ধরনের উদাহরণের সাহায্য নিয়ে দুটো বিষয়ের মৌলিক পার্থক্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন । তিনি আমাদের জানিয়েছিলেন – “সকালের সূর্যের আলাের সঙ্গে তুলনা করলে বৈদ্যুতিক বাতিকে কতটা নিষ্প্রভ লাগে ”। তিনি আমাদের একথাও বলেছেন যে ,“আমাদের আধ্যাত্ম জীবনে যে ধরনের আনন্দ আমরা পেতে পারি তার কাছে জাগতিক জীবনের সুখ কোনাে কিছুই নয় । কিন্তু আমরা তাে এই উপলব্দিটা করে উঠতে পারি না । আমরা যেন সবসময় একটা মায়ার জগতের মধ্যে বাস করছি , আমরা সকলেই আমাদের জাগতিক সুখটাকে পারমাত্মিক সুখ ভেবে ভুল করি ।”
মানুষ যদি আধ্যাত্মিক জীবনের সাধনা করতে চায় তাহলে তার সাথে তার জীবনের একাত্বতা জড়িয়ে থাকে । প্রত্যেকটা মানুষই সবকিছু থেকে মুক্তির জন্য নিজেকে নিয়ােগ করবে । আর যে সমস্ত মানুষ নিজেদেরকে ব্যক্তিত্বের শীর্ষে নিয়ে যেতে পারেন , তারাই পারেন নিজেদের আত্মিক শক্তিটাকে বাড়িয়ে তুলতে , একমাত্র তাদের মাধ্যমেই সৎ , শােভন আর সুন্দর নিয়ন্ত্রিত একটা সমাজ সৃষ্টি হতে পারে । তবে যে সমস্ত মানুষেরা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থপূরণ করার জন্য জগতে এসেছেন , সেই সমস্ত মানুষেরা সমাজের ক্ষতি করেন ।
রাধাকৃষ্ণাণ ও হিন্দুধর্ম : রাধাকৃষ্ণাণ বলেছিলেন , হিন্দুধর্মের মধ্যে বিভিন্ন রােমাঞ্চকর বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে । পাশ্চাত্য দেশীয় বুদ্ধিজীবীদের কাছে তাই এই ধর্মের কিছু কিছু অংশকে দুর্বোধ্য বলে মনে হয় । রাধাকৃষ্ণাণ স্বচ্ছ ভাষায় হিন্দুধর্মের এই অন্তর্নিহিত রহস্যের কথা বলতে চেয়েছিলেন । তিনি একটির পর একটি অত্যন্ত সহজ উদাহরণ দিয়ে সাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন । যেখানে যত অন্ধকার ছিল , তার প্রতিভার আলােকশিখায় তা দূরীভূত হয় । তার জন্য আমাদের মৌল হিন্দুবাদ প্রচার করতে হবে এমনটি নয় । যিনি যে ধর্মের অনুগামী , তিনি সেই ধর্মের নির্দেশ পালন করতে পারবেন । শুধু তাকে হিন্দুধর্মের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে হবে । বংশপরম্পরায় যে ধার্মিক ভাবনার স্রোত এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে , তাকে বুঝতে হবে । তাতে তিনি হিন্দুধর্মের রহস্য সম্পর্কে জানতে পারবেন ।
এই ভাষণকে কেন্দ্র করে লন্ডন শহরে আলােচনার ঝড় বয়ে যায় । অনেক বলেছেন ,রাধাকৃষ্ণাণ ইচ্ছে করেই হিন্দুধর্মের অন্তনিহিত অতীন্দ্রিয়বাদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন ।
শেষকথা : যে সময়ে রাধাকৃষ্ণাণ পৃথিবীতে এসেছিলেন , সেই সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে নানা রকমের অশান্তির আগুন দেখা যেত । আর রাধাকৃষ্ণাণ মনে প্রাণে এটা মানতেন যে , সেই যুগটা ছিল মানব সমাজের পক্ষে আতঙ্ক ,অবিশ্বাস আর হিংসার একটি অধ্যায় । কিন্তু এ যুগের মধ্যে দিয়ে পথ চলতে গিয়েই মানুষ আরাে বেশি করে সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়বে । এখনকার ধর্মের কার্যকরী আর তাত্ত্বিক দুটি দিকই হল — অভয় । এখন মানুষ শত্রু আর মিত্রের মধ্যে কোনাে ভেদাভেদ করে না । সে আপন আর পরের মধ্যে কোনাে বিভাজন স্থাপন করবে না । আমাদের সকলকে এমন একটা মন্ত্রে জেগে উঠতে হবে যে মন্ত্র আমাদের আত্মার স্বরূপ দেখাতে পারবে ।