উত্তর : জ্ঞান অভিজ্ঞতা নির্ভর : আমাদের সকল জ্ঞানই অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত । আনুমানিক জ্ঞান , যেখানে সামান্য হইতে সামান্যতর বা সামান্য হইতে বিশেষ জ্ঞানে উপনীত হই , তারও কারণ ভিত্তি— অভিজ্ঞতা । যেগুলিকে নিশ্চিত —বিজ্ঞান বলে , সেগুলির সত্যতা লােকে সহজেই বুঝতে পারে , কারণ ঐগুলি প্রত্যেকের বিশেষ বিশেষ অভিজ্ঞতা স্পর্শ করে । এখন প্রশ্ন এই ধর্মের এরূপ সাধারণ ভিত্তি ভূমি কিছু আছে কি না ? ইহার উত্তরে আমাকে ‘হ্যা’এবং ‘না’ — দুই ই বলিতে হবে ।
পৃথিবীতে সচরাচর যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহাতে বলা হয় — ধর্ম কেবল শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের উপর স্থাপিত , অধিকাংশ স্থলেই উহা ভিন্ন ভিন্ন মতের সমষ্টি মাত্র । এইজন্যই দেখিতে পাই , সবধর্মই পরস্পর বিবাদ করিতেছে । এই মতগুলি আবার বিশ্বাসের উপর স্থাপিত , একজন বলিলেন , মেঘের উপরে এক মহান পুরুষ বসিয়া আছেন , তিনিই সমগ্র জগৎ শাসন করিতেছেন , বক্তা আমাকে তাহার কথার উপর নির্ভর করিয়াই উহা বিশ্বাস করিতে বলেন । প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তিই যেন বলিতে চায় ‘এই সব ধর্মতাে দেখছি কতকগুলাে মত মাত্র, এগুলাের সত্যাসত্য বিচারের কোনাে মানদণ্ড নেই , যার যা খুশি সে তাই প্রচার করতে ব্যস্ত । এ সব সত্ত্বেও ধর্মবিশ্বাসের এক সার্বভৌম মূলভিত্তি আছে — উহাই বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মতবাদ ও সর্ববিধ বিভিন্ন ধারণাসমূহের নিয়ামক । ঐগুলির ভিত্তি পর্যন্ত অনুসরণ করিলে আমরা দেখিতে পাই যে, এগুলি সর্বজনীন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
শ্রেণিবিভাগ : প্রথমত , পৃথিবীর ভিন্ন ধর্মগুলি একটু বিশ্লেষন করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, উহারা দুই শ্রেণিতে বিভক্ত । কতকগুলি শাস্ত্র বা গ্রন্থ আছে , কতকগুলির তাহা নাই । যেগুলি শাস্ত্রের উপর থাপিত , সেগুলি সুদৃঢ়, উহাদের অনুগামীর সংখ্যাও অধিক । শাস্ত্র ভিত্তিহীন ধর্মসকল প্রায়ই লুপ্ত । কতকগুলি নূতন হইয়াছে বটে , কিন্তু খুব কম লােকই ঐগুলির অনুগত । তথাপি উক্ত সকল সম্প্রদায়ের মতে ওই ঐক্য দেখা যায় যে ,উহাদের শিক্ষা বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফলস্বরুপ । খ্রিস্টান তাহার ধর্মে , যীশুখ্রিস্ট ও তাহার আবতারত্বে , ঈশ্বর ও আত্মার অস্তিত্বে এবং আত্মার ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনায় বিশ্বাস করিতে বলিবেন । যদি আমি তাহাকে এই বিশাসের কারণ জিজ্ঞাসা করি , তিনি বলিবেন — “ইহা আমার বিশ্বাস ।” কিন্তু যদি তুমি খ্রিস্টধর্মের মুল উৎসে গমন করো , তাহা হইলে দেখিতে পাইবে যে ,উহাও প্রত্যক্ষ অনুভূতির উপর স্থাপিত । যীশুখ্রীস্ট বলিয়াছেন , ‘আমি , ঈশর দর্শন করিয়াছি ।’ তাহার শিষ্যরাও বলিয়াছিলেন , ‘আমরা ঈশ্বরকে অনুভব করিয়াছি ।’ এইরুপ আরও অনেকের কথা শুনা যায় ।
বৌদ্ধ ধর্মেও এইরূপ , বুদ্ধদেবের প্রত্যক্ষানুভূতির উপর এই ধর্ম স্থাপিত । তিনি কতকগুলি সত্য অনুভব করিয়াছিলেন , সেগুলি দর্শন করিয়াছিলেন , সেইসকল সত্যের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন এবং সেগুলিই জগতে প্রচার করিয়াছিলেন । হিন্দুদের সমন্বন্ধেও এইরূপ , তাহাদের শাস্ত্রে ঋষি নামধেয় গ্রন্থ কর্তাগণ বলিয়া গিয়াছেন , ‘আমরা কতকগুলি সত্য অনুভব করিয়াছি ।’
যােগ বিদ্যার আচার্যগণ তাই বলেন , “ধর্ম,কেবল পূর্বকালীন অনুভূতির উপর স্থাপিত নয়, পরন্তু স্বয়ং এই সকল অনুভূতি হয় তাহার নাম ‘যােগ’ । ধর্ম যতদিন না অনুভূত হইতেছে , ততদিন ধর্মের কথা বলাই বৃথা । ভগবানের চোখে এত গন্ডগােল , যুদ্ধ ও বাদানুবাদ কেন ? ভগবানের নামে যত রক্তপাত হইয়াছে , অন্য কোনাে বিষয়ের জন্য এত রক্তপাত হয় নাই ,কারণ সাধারণ মানুষ ধর্মের মূল উৎসে যায় নাই । আত্মা অনুভূতি না করিয়া , আত্মা তথা ঈশ্বর দর্শন না করিয়া ‘ঈশ্বর আছেন’ বলিবার কী অধিকার মানুষের আছে ? যদি ঈশ্বর থাকেন তাহাকে দর্শন করিতে হইবে , যদি আত্মা বলিয়া কিছু থাকে , তাহা উপলদ্ধি করিতে হইবে ।
সত্যানুসন্ধানী : মানুষ সত্য চায় , স্বয়ংসত্য অনুভব করিতে চায়, সত্যকে ধারণা করিতে , সত্যকে সাক্ষাৎ করিতে , অন্তরের অন্তস্থে অনুভব করিতে চায় । ‘কেবল তখনই , সকল সন্দেহ চলিয়া যায় ,সব তমােজাল ছিন্ন ভিন্ন হইয়া যায়, সকল বক্তৃতা সরল হইয়া যায় । বেদ এইরূপ ঘােষণা করে ‘হে অমৃতের পুত্রগণ , হে দিব্যধাম নিবাসিগণ , শ্রবণ কর আমি এই অজ্ঞানান্ধকার হইতে আলােকে যাইবার পথ পাইয়াছি , যিনি সকল তমসার পারে , তাহাকে জানিতে পারিলেই ( লােক ) মৃত্যু অতিক্রম করিতে পারে , মুক্তির আর কোনাে উপায় নাই ।
রাজযােগ বিজ্ঞানের লক্ষ্য : এই সত্য লাভ করিবার প্রকৃত কার্যকর ও সাধনােপযােগী বৈজ্ঞানিক প্রণালী মানবসমক্ষে স্থাপন করা । এখানেও একটি নির্দিষ্ট প্রণালী অনুসরণ করিতে হইবে , পরীক্ষাগারে গিয়া বিভিন্ন দ্রব্যাদি লইতে হইবে , ঐগুলি মিশাইয়া যৌগিক পদার্থে পরিণত করিতে হইবে , পরে ঐগুলি লইয়া পরীক্ষা করিলে তবে তুমি রসায়নবিদ হইতে পারিবে । যদি তুমি জ্যোতির্বিদ হইতে চাও , তাহা হইলে তােমাকে মানমন্দিরে গিয়া দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করিতে হইবে , তবে তুমি জ্যোতির্বিদ হইতে পারিবে । প্রত্যেক বিদ্যারই এক একটি নির্দিষ্ট প্রণালী থাকা উচিত । আমি তােমাদিগকে শত সহস্র উপদেশ দিতে পারি , কিন্তু তােমরা যদি সাধনা না কর , তােমরা কখনই ধার্মিক হইতে পারিবে না । সকল যুগে সকল দেশেই নিষ্কাম শুদ্ধ স্বভাব জ্ঞানীগণ এই সত্য প্রচার করিয়া গিয়াছেন ।
কোনাে জ্ঞান লাভ করিতে হইলে আমরা সামান্যীকরণের সাহায্য লইয়া থাকি , সামান্যীকরণ আবার পর্যবেক্ষণের উপর প্রতিষ্ঠিত । প্রথমে আমরা ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করি , পরে সেইগুলিকে সাধারণ সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করি , শেষে তাহা হইতে আমাদের সিদ্ধান্ত বা মূলনীতি উদ্ভাবন করি । যতক্ষণ না মনের ভিতর কি হইতেছে তাহা প্রত্যক্ষ করিতে পারি, ততক্ষণ আমরা মন সম্বন্ধে , মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতি সম্বন্ধে, মানুষের চিন্তা সম্বন্ধে কিছুই জানিতে পারিনা ।
সিদ্ধান্ত : তাহা হইলে এ পর্যন্ত দেখিলাম , এ রাজযােগের আলােচনায় কোনাে প্রকার বিশ্বাসের প্রয়ােজন নাই । যতক্ষণ না নিজে প্রত্যক্ষ করিতেছ , ততক্ষণ কিছুই বিশ্বাস করিও না — রাজযােগ ইহাই শিক্ষা দেয় । সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য অন্য কিছুর সাহায্য প্রয়ােজন হয় না । তােমরা কি বলিতে চাও যে , জাগ্রত অবস্থার সত্যতা প্রমাণ করিতে স্বপ্ন অথবা কল্পনার সাহায্য আবশ্যক ? কখনই নয় । এই রাজযােগ সাধনে দীর্ঘকাল ও নিরন্তর অভ্যাসের প্রয়ােজন । এই অভ্যাসের কিছু অংশ শরীর সংযম বিষয়ক , কিন্তু , ইহার অধিকাংশই মনঃসংযমাত্মক । অধিকাংশ লােকেরই মন বিশেষভাবে শরীরের অধীন , তাহাদের মন অতি অল্প বিকশিত । তােমরা যদি কিছু মনে না কর , রাজযােগীদের মতে বহির্জগতের বা সূক্ষ্মজগতের স্থূল রূপমাত্র । সর্বত্রই সূক্ষ্ম কারণ ও স্থূলকার্য । অতএব এই নিয়মে বহির্জগৎ কার্য ও অজগৎ কারণ । অনুরূপভাবে বহির্জগতের শক্তিগুলি অভ্যন্তরীণ সূক্ষ্মভাব ছাড়া কিছু নয় ।