উত্তর : ধর্ম,অর্থ , কাম এবং মােক্ষ চারটি পুরুষার্থের মধ্যে মােক্ষকে পরম পুরুষার্থ বলা হলেও মােক্ষের স্বরূপ বিষয়ে ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ আছে । ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়গুলি মােক্ষ বলতে নিঃশ্রেয়স , মুক্তি, অপবর্গ , নির্বাণ , কৈবল্য প্রভৃতি বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন ।
চার্বাক মতে মােক্ষ : চার্বাক মতে , চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা । আত্মা দেহাতিরিক্ত কোন সত্তা নয় ।দেহের বিনাশের সাথেই আত্মারও বিনাশ হয় । তাই , মৃত্যুই মুক্তি (মারণং চ অপবর্গঃ ) ।
বৌদ্ধ মতে মােক্ষ : বৌদ্ধ দর্শনের মােক্ষ হল নির্বাণ । চারটি আর্যসত্যসহ অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন দ্বারা দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি বা নিরােধ হয় এবং মােক্ষ লাভ হয় ।
জৈন মতে মােক্ষ : জৈন মতে , আত্মা স্বরূপতঃ অনন্ত জ্ঞান ,অনন্ত সক্তি, অনন্ত দর্শন ও অনন্ত আনন্দয় হলেও পুদগাল অর্থাৎ জড় পরমাণুর সংস্রবে এসে বদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয়ে যাবতীয় দুঃখভােগ করে । আবার , সম্যক্ জ্ঞান, সম্যক দর্শন ও সম্যক্ চারিত্র দ্বারা আত্মা পুনরায় স্বরূপে অবস্থান করে । আত্মার স্বরূপে অবস্থানই মােক্ষ ।
ন্যায় মতে মােক্ষ : ন্যায় মতে , আত্মা স্বরূপতঃ অচেতন হলেও দেহ ও মনের সংস্পর্শে এসে চৈতন্য লাভ করে এবং বদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয়ে সুখ দুঃখ ভােগ করে । অজ্ঞানবশত আত্মা বদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয় বলে অজ্ঞানতা দূর হলেই আত্মার দেহবন্ধন থেকে মুক্তি হয় । এই দেহবন্ধন থেকে মুক্তিই মােক্ষ ।
বৈশেষিক মতে মােক্ষ : বৈশেষিক দর্শনে মােক্ষকে নিঃশ্রেয়স বলা হয়েছে । মােক্ষ হল দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি । মিথ্যা জ্ঞান দ্বারা আত্মা , দেহ , ইন্দ্রিয় ও মনের সাথে নিজেকে অভিন্ন মনে করে বদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং যাবতীয় দুঃখ ভােগ করে । আর , শ্রবণ, মনন ও নিধিধ্যাসন দ্বারা যথার্থ জ্ঞান হলে মিথ্যা জ্ঞান দূর হয় এবং আত্মা মুক্তি বা মােক্ষ লাভ করে ।
সাংখ্য মতে মােক্ষ : সাংখ্য মতে , মােক্ষ হল পুরুষের স্বরূপে অবস্থান । অবিবেকবশতঃ নিত্য , শুদ্ধ , বুদ্ধ ও মুক্তস্বভাব আত্মা বা পুরুষ প্রকৃতির সাথে নিজেকে অভিন্ন মনে করে বৃদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয় । আবার ,বিবেকজ্ঞান জাগ্রত হলে পুরুষ প্রকৃতির ভেদ জ্ঞানের সাক্ষাৎ উপলব্ধি হয় এবং মােক্ষ লাভ হয় ।
যােগ মতে মােক্ষ : যােগ দর্শনে পুরুষের আত্মস্বরূপে অবস্থানকেই মােক্ষ কৈবল্য বলা হয়েছে । বিবেকখ্যাতিই কৈবল্যলাভের উপায় । অষ্টাঙ্গ যােগ দ্বারা বিবেক খ্যাতি জাগ্রত হয় , যার ফল মােক্ষ ।
মীমাংসা মতে মােক্ষ : প্রাচীন মীমাংসক মতে , বৈদিক যজ্ঞাদি - কর্মানুষ্ঠান দ্বারাস্বর্গ সুখ লাভ হয় । পরবর্তী মীমাংসক মতে , নিষ্কামভাবে বেদবিহিত যজ্ঞাদি কর্মানুষ্ঠান দ্বারা আত্মা বন্ধন মুক্তি হয় । এইরূপ বন্ধন মুক্তিই মােক্ষ ।
বেদান্ত মতে মােক্ষ : আত্মা স্বরূপতঃ মুক্ত স্বভাব হলেও অজ্ঞানবশত নিজেকে দেহের সাথে অভিন্ন মনে করে বদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং সুখ -দুঃখ ভােগ , করে । আর অজ্ঞান দূর হলেই আত্মা স্বরূপে অবস্থান করে । আত্মার স্বরূপে অবস্থানই মােক্ষ ।
শঙ্করাচার্যের মতে : সাধন চতুষ্টয় দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভের পর শ্রবণ , মনন ও নিদিধ্যাসন দ্বারা অজ্ঞানের নিবৃত্তি হয় এবং মােক্ষ লাভ হয় । তাই , অজ্ঞানের নিবৃত্তিই মােক্ষ ।
রামানুজ মতে , আত্মার বা জীবের কর্মের ফলেই দেহ প্রাপ্তি হয় এবং দেহ বন্ধন হয় । জ্ঞান এবং কর্মই মােক্ষ লাভের উপায় । এর জন্য ভগবৎ কৃপারও প্রয়ােজন ।