অমঙ্গলের সমস্যা বলতে রবীন্দ্র ভাবনা কী ?অমঙ্গল ও মঙ্গলময়তা রবীন্দ্রনাথ কীভাবে ব্যক্ত করেছেন ?

অনাস পাস দর্শন honours pass general philosophy questions answers প্রশ্নোত্তর অমঙ্গলের সমস্যা বলতে রবীন্দ্র ভাবনা কী অমঙ্গল ও মঙ্গলময়তা রবীন্দ্রনাথ কীভাবে ব্যক্ত করেছেন amongoler somossa bolte robindronath vabna ki amongol o mongolmoyota robindronath kivabe baktto korechen questions answers


উত্তর : অমঙ্গল কী : যা মানুষের জীবনে দুঃখ কষ্ট আনয়ন করে — তাই অমঙ্গল । অমঙ্গল মানুষের জীবন ও সমাজে একটা বিপর্যয় । অমঙ্গলের বিপর্যয় হিসেবে অপমৃত্যু , দুর্ঘটনা, রােগ শােক , প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতির কথা বলা যায় । 

অমঙ্গল নিয়ে আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে রবীন্দ্র ভাবনাতেই ভাবনা চিন্তার সময় এসেছে । এখন প্রশ্ন এই অমঙ্গলের সৃষ্টি কর্তাকে ? ঈশ্বরতাে সর্বমঙ্গলময় । সর্বমঙ্গলের কর্তা হয়ে তিনি কি অমঙ্গল সৃষ্টি করতে পারেন ? সৃষ্টিকর্তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও অমঙ্গলের অস্তিত্ব নিয়ে কোনাে প্রশ্ন থাকতে পারে না । অমঙ্গল বাস্তব ঘটনা । পৃথিবী যেহেতু ঈশ্বরের প্রকাশ , তাই অমঙ্গলের পশ্চাৎ নায়ক হিসেবে ঈশ্বরকেই দায়ী করতে হয় । 


মানুষতাে অমৃতের সন্তান । কিন্তু সন্তানকে অযথা দুঃখ দিয়ে পিতা কি আনন্দিত থাকতে পারেন । সমস্ত বিশ্ব জুড়ে খাদ্যাভাব ,রােগ শােক, অকালমৃত্যু , জন্ম, প্রতিবন্ধী,প্রাকৃতিক বিপর্যয় — এসব সৃষ্টি করেও ঈশ্বরের মুখে তাে বিষন্নতার হাসি থাকে না । ঈশ্বরকে বুঝি কঁদতে নেই । মানুষের জীবনে বিপর্যয় এনে ঈশ্বরের কি লাভ হয় , এতকিছুর মধ্যেও ঈশ্বর সদাসর্বদা হাস্যময় । উত্তর তৈরি রেখেছেন নীতি বাগীশরা সবই পাপের ফসল । প্রশ্ন থেকেই যায় জন্মের পরই তাে কেউ পাপী হয় না, পাপ তাে সৃষ্টি করা হয় । সেই সুবিখ্যাত উক্তি — 
  

             “পাপকে ঘৃণা করাে পাপীকে নয়”

কী দরকার ছিল পাপের কলঙ্ক মানুষের মাথায় চাপিয়ে দেবার । শাস্ত্রবিদরা এর পক্ষ নিয়ে বলেন ঈশ্বর জীবন নাটকের নাট্যকার । একটা নাটক শুধু সুদর্শন নায়ক নায়িকাকে নিয়ে চলতে পারে না , একটা নাটক শুধু খলনায়ক কে নিয়ে চলতে পারে না , একটা নাটক শুধু হাস্যরস দিয়ে চলতে পারে না, একটা নাটক শুধু করুণরস দিয়ে চলতে পারে না, নাটককে সাফল্যমণ্ডিত করতে সমাজের ভালাে , খারাপ , চোর ডাকাত , বদমাইস , খুনি , পতিতা সবাইকে দরকার । ঈশ্বর যাকে চোর ডাকাত , পতিতা করেছেন সে কেন সেই অবস্থার দাস ? শাস্ত্রবিদরা বলেন এ সব পূর্বজন্মের পাপের ফল , কিন্তু এই পাপের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা যাবে পাপ ঈশ্বরেরই সৃষ্টি । ঈশ্বরের পাপই মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হয় । পৃথিবীর বহু ধর্মগ্রন্থ এর প্রমাণ রাখে । 

উপরের আলােচনা থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় ঈশ্বরকে স্বীকার করলে অমঙ্গলকে অস্বীকার করতে হয় । আবার অমঙ্গলকে স্বীকার করলে ঈশ্বরকে অস্বীকার করতে হয় । তাই রবীন্দ্র হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে । ঈশ্বর ও অমঙ্গল , অমঙ্গল ও ঈশ্বর এই দ্বন্দ্বে । 

ঈশ্বরের সর্বশক্তিময়তা : আমরা যেহেতু রবীন্দ্রভাবনাতেই জাড়িত এবং রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর বিশ্বাসী হয়েও যুক্তির পথ থেকে সরে আসেননি । দেখা যায় যারা নাস্তিক বা জড়বাদী তাদের কাছে অমঙ্গল কোনাে সমস্যার মধ্যে পরে না । কারণ তারা ঈশ্বর মানেন না । এদের কাছে মঙ্গল বা অমঙ্গল উভয়ই মনুষ্য সৃষ্ট । রবীন্দ্রনাথ যেহেতু ঈশ্বরের আশ্রয়ে আশ্রিত , তাই তাঁর কাছে অমঙ্গল একটা সমস্যা বিশেষ । ঈশ্বর সর্বশক্তিময় ও মঙ্গলময় হয়েও কেন তিনি জগৎ এ অমঙ্গল সৃষ্টি করলেন । মানুষকে কাঁদিয়ে ঈশ্বরের কী লাভ ? ‘রক্তকরবী’ নাটকে তিনি নন্দিনীর মুখ দিয়ে বলিয়ে ছিলেন “ঈশ্বরের কোনাে দায় নেই । মানুষের দায় তার নিজস্ব” অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ দেখাতে চাইলেন ঈশ্বর যেহেতু সর্বশক্তিময় তাই অমঙ্গলের ধারণাটি স্ব-বিরােধী দোষে দুষ্ট । একটিকে স্বীকার করতে গেলে আরেকটিকে অস্বীকারের প্রশ্ন এসে যায় । 


ঈশ্বর মানুষের জন্যই জগৎ সৃষ্টিকরেছেন । মানুষ তার নিজের ইচ্ছায় স্বাধীন । ফলত মানুষ ভালাে কাজ বা খারাপ কাজ দুই ই করতে পারে । আবার হিন্দু ধর্ম প্রমাণ রাখে দুষ্কৃতিকে দমন করতে এবং সাধুকে পরিত্রাণ করতে ঈশ্বর বার বার পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন । অবতার রূপে ঈশ্বর নেবে আসবেন মর্তের মাটিতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তার একটি প্রমাণ । এখানে প্রমাণ হয় যে , অমঙ্গল কে বিনাশের জন্য মঙ্গলকেই প্রয়োজন । অশুভকে ধ্বংস করে শুভের উদবর্তনের জন্যই মঙ্গল ও অমঙ্গলের কখনো বিরোধ কখনো সন্ধি । 



আমার ভাবনা : ঈশ্বর যতই করুণাময় ও মঙ্গলময় হোক না কেন পৃথিবীতে তাঁর নিজ অস্তিত্বের জন্যে মানুষকেই প্রয়োজন । মানুষের হাত ধরেই ঈশ্বর পৃথিবীর পথ পরিক্রমা করে চলেছেন । জগতে দুঃখ না থাকে , জগতে যদি অকালমৃত্যু না থাকে , জগতে যদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় না থাকে, কে ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবতো ? কে ঈশ্বরের পায়ে নিজেকে নিয়োজিত করতো । ভালো খারাপ , সৎ অসৎ এসব তো আপেক্ষিকতার প্রশ্ন , এই একটা বিষয়কেই সামনে রেখে ঈশ্বর মানুষকে একটা সুতোয় বেঁধে ফেলেছেন । যৌবনের যে ঘোর নাস্তিক পৌঢত্তে সে ঈশ্বরের নিয়োজিত প্রাণ । ওপারে যাবার টিকিট সংগ্রহ ব্যাস্ত । ঈশ্বর আর একটা জটিল আবতে মানুষকে বেঁধেছেন  । গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন –



     “ কর্মেন্য ব্যাধি কারস্তে , মা ফলেশু কদাচন ।”

কর্ম করবে তুমি ফল দান করবো আমি । ছাত্র পরীক্ষা দেবে আর নম্বর দেবেন শিক্ষক । আধুনিক যুগ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে আজকের শিক্ষকরা তো অনেক ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ থাকেন না । তাহলে ।



মূল্যায়ণ : রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মানুষ যদি জৈবিক দিক থেকে , জৈবিক প্রবৃত্তির দিক থেকে জগৎকে দেখে থাকে তাহলেই সে অমঙ্গলের সম্মুখীন হয়ে থাকে । কিন্তু মানুষ যদি নিষ্কাম কর্মের নৌকায় চেপে জীবন সমুদ্র অতিক্রম করতে চায় তাহলে অমঙ্গল তাকে স্পর্শ করতে পারে না । মানুষ যখন মানুষ হয়েও মানুষের সীমানার বাইরে চলে যাবে , তাঁর কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ ঘটবে । মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ বিকাশসাধন ঘটবে । তখন মানুষের জীবনে অমঙ্গল বা দুঃখ কষ্ট থাকবে না । অর্থাৎ মঙ্গল অমঙ্গলের ধারণা একটা দৃষ্টিগত ধারণা । নিষ্কাম কর্মের যাত্রাপথেই পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলন ঘটবে – 

         একদা মিলন হইল দোঁহে 
 
                        কি ছিল বিধাতার মনে 


অর্থাৎ , ঈশ্বর ও অমঙ্গল উভয়েই স্বীকৃত ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন