উত্তর : জড়বাদ বলতে বােঝায় সেই মতবাদকে যেখানে জড়কেই যাবতীয় বিষয়ের মূল তত্ত্ব বলা হয়েছে । আধ্যাত্মবাদের বিরােধিতা করতে গিয়েই ভারতীয় দর্শনে চার্বাকগন , জড়বাদ তত্ত্ব প্রচার করেছেন । তাই , ভারতীয় দর্শনের জড়বাদ হল চার্বাকদের জড়বাদী তত্ত্ব ।
জড়বাদের মূল তত্ত্ব : জড়বাদ অনুযায়ী জগৎ এবং জাগতিক বিষয়গুলির উপাদান হল জড় । অজড় কোন তত্ত্ব চার্বাক জড়বাদে স্বীকৃত হয়নি । আমরা আপাতভাবে যেগুলি অজড় তত্ত্ব বলে থাকি (যেমন চৈতন্য , আত্মা , ইত্যাদি ) সেগুলিকেও জড়বাদীরা জড়ের দ্বারাই সৃষ্ট বলে মনে করেন । চার্বাকরা প্রত্যক্ষবাদী হিসাবে যাবতীয় বিষয়ের মূলতত্ত্ব হিসাবে ভূতচারটির কথা বলে । ক্ষিতি, অপ , তেজ , মরুৎ ও ব্যোম্ বা আকাশ নামক পঞ্চভূতের কথা ভারতীয় দর্শনে থাকলেও চার্বাকগণ ব্যোম্ বা আকাশকে ভূত বলে মানেননি । কারণ , ব্যোম বা আকাশকে প্রত্যক্ষকরা যায় না । কাজেই , চার্বাক মতে ,যাবতীয় বিষয়ের মূল তত্ত্ব বা উপাদান হল চারটি ভূত — ক্ষিতি, অপ , তেজ ও মরুৎ । চার্বাকদের এই মতকে ভূতচতুষ্টয়বাদ বলে ।
প্রমাণের আলােচনা : চার্বাক দর্শনে প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করা হয় । ভারতীয় দর্শনে প্রত্যক্ষ ছাড়াও অনুমান , শব্দ, উপমান প্রভৃতি প্রমাণের আলােচনা থাকলেও চার্বাক মতে প্রমাণ একটিই , সেটি হল প্রত্যক্ষ । প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ বলার ক্ষেত্রে অনুমান , শব্দ ইত্যাদি যে প্রমাণ নয় তার পক্ষেও যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন অনুমান প্রভৃতি প্রমাণের দ্বারা যথার্থ ও নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যায় না । আর , প্রমাণ শব্দের অর্থ যেহেতু যথার্থ জ্ঞানলাভের উপায় সেহেতু , অনুমান , শব্দ ইত্যাদিকে প্রমাণ বলা যায় না ।
জগতের ব্যাখ্যা : চার্বাক দর্শনে জড়বাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ক্ষিতি, অপ , তেজ ও মরুৎ এই চারটি জড়ভূতকে জগতের মূল উপাদান বলা হয়েছে । চার্বাক মতে , এই ভুতচারটি জড় হলেও নিজেদের অর্ন্তনিহিত স্বভাবের দ্বারা কোন নিমিত্ত কারণ ছাড়াই পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে জগৎ ও জাগতিক বস্তুগুলির সৃষ্টি করেছে । চার্বাকদের এই মতকে স্বভাববাদ বলে । অনেক সময় একে যদৃচ্ছাবাদ বা আকস্মিকবাদও বলা হয় । কারণ , জড়ভূতগুলি নিজেদের স্বভাব দ্বারা আকস্মিক ভাবেই পরস্পরের সাথে মিলিত হয় ।
চৈতন্য বা আত্মা : চার্বাক দর্শনে জড়বাদী ও প্রত্যক্ষবাদী হিসাবে জড় ভূত চারটিকেই জগতের মূল উপাদান বা তত্ত্ব বলায় চৈতন্য বা আত্মার উৎপত্তির ক্ষেত্রে ও চার্বাকগণ ভূত চারটির কথাই বলেছেন । চার্বাক মতে , ক্ষিতি, প্রভৃতি ভূত চারটি জড় হলেও এদের নির্দিষ্ট পরিমাণ মিশ্রণের মাধ্যমে চৈতন্য নামক নতুন একটি গুণের আবির্ভাব ঘটে । এই চৈতন্য নামক গুণ সমন্বিত যে দেহ তাই আত্মা । দেহ যেমন জড় ভূতের সমন্বয়ে গঠিত আত্মার চৈতন্যও তেমনি জড়ভূতের দ্বারাই সৃষ্ট । আর চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা । কাজেই , চৈতন্য বা আত্মার উৎসও জড় চারটি ভূত ।
ঈশ্বর : চার্বাক দর্শন নিরীশ্বরবাদী কারণ , তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে না । ভারতীয় দর্শনে জগৎ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে নিমিত্ত কারণ রূপে স্বীকার করা হয় । কিন্তু চার্বাক মতে ,ভূত চারটি হল উপাদান কারণ এবং নিমিত্ত কারণ হল ভূত চারটির নিজস্ব স্বভাব । কাজেই নিমিত্ত কারণরূপে ঈশ্বর বা সচেতন কৰ্ত্তার অস্তিত্ব স্বীকারের প্রয়ােজন নেই । তাছাড়া ,ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করা যায় না । কারণ , চার্বাক মতে , যা প্রত্যক্ষযােগ্য তাই সত্য ও অস্তিত্বশীল । আর , যার প্রত্যক্ষ হয় না তার কোন অস্তিত্ব নেই ।
চার্বাক নীতিতত্ত্ব : চার্বাক দর্শনে সুখবাদকেই সমর্থন করা হয়েছে । চার্বাক মতে , সুখই মানুষের একমাত্র কাম্য । তাই সুখভােগই পরম পুরুষার্থ । সুখ বলতে ইন্দ্রিয় সুখ বা কাম এর কথাই বলা হয়েছে । সুখবাদের পক্ষে চার্বাকদের যুক্তিহল মৃত্যুর পর যেহেতু জীবনে সবকিছুই শেষ হয়ে যায় সেহেতু ‘যতদিন বাঁচ, সুখে বাঁচ’ ( যাবৎ জীবেৎ সুখম জীবেৎ ) , প্রয়ােজনে ‘ঋণ করেও ঘৃত খাও’ (ঋণং কৃত্বাঘৃতং পিবেৎ ) ।
সমালােচনা : জড়বাদ আধ্যাত্মবিরােধী একটি মতবাদ হিসাবে ভারতীয় দর্শনে গুরুত্ব লাভ করলেও এই মতবাদ পরবর্তীকালে বিভিন্নভাবে সমালােচিত হয়েছে যথা—
১ ) চার্বাকরা প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ বললেও ব্যবহারিক জীবনে আমাদের প্রতিনিয়তই অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয় । জৈন মতে ,অনুমানকে অস্বীকার করলে যুক্তি তর্ক আলােচনা সবই অসম্ভব হয়ে পড়ে ।
২ ) চার্বাকরা অনুমানের প্রমাণ্য অস্বীকার করেছেন ।কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যাবতীয় বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত সবই অনুমান নির্ভর , এবং পরবর্তীকালে তা সত্য বলে প্রমাণিত হয় । কাজেই , অনুমান মাত্রই ভ্রান্ত একথা ঠিক নয় ।
৩ ) চার্বাকরা জড়বাদী হিসাবে আত্মা , পরজন্ম ইত্যাদিকে অস্বীকার করেছেন । কিন্তু আত্মার স্থায়িত্ব অস্বীকার করলে স্মৃতিকে ব্যাখ্যা করা যায় না ।
৪ ) চার্বাকরা ঈশ্বর মানেন না ,কিন্তু সৃষ্টি যার উদ্দেশ্যে সিদ্ধ করে সেই নিমিত্ত কারণ বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হয় । কারণ , সৃষ্টি কখনাে উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না ।