মাধ্যমিক বৌদ্ধদের দার্শনিক মতবাদ বা শূন্যবাদের মূল তত্ত্বগুলি আলােচনা করো ।

অনাস পাস দর্শন honours pass general philosophy মাধ্যমিক বৌদ্ধদের দার্শনিক মতবাদ বা শূন্যবাদের মূল তত্ত্বগুলি আলােচনা করো madhyamik boudhoder darshonik motobad ba shunnobader mul tottoguli alochona koro questions answers


উত্তর : মহাযান বা ভাববাদী সম্প্রদায়ভুক্ত মাধ্যমিক বৌদ্ধগণের দার্শনিক মতবাদ শূন্যবাদ নামে পরিচিত । কারণ , মাধ্যমিক বৌদ্ধ মতে , বাহ্য জগৎ এবং মনােজগৎ কোনাে কিছুরই সত্তা নেই । সবই শূন্য এবং শূন্যই একমাত্র সৎ । কারণ , বাহ্য জগতের অস্তিত্ব থাকলে বা বাহ্য জগৎ সত্য হলে তা মনের সাহায্যে জানা যেত । কোনাে কিছুর জ্ঞানলাভের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় থাকে — মন বা জ্ঞাতা, বস্তু বা জ্ঞেয় বিষয় এবং বস্তু সম্বন্ধীয় জ্ঞান । এই তিনটির কোনাে একটি মিথ্যা হলে তিনটিই মিথ্যা হয় । রঞ্জুসর্পের ক্ষেত্রে সর্পটি মিথ্যা বলে মনও মিথ্যা । কারণ ,সর্পটি মনেরই সৃষ্টি । কাজেই , বাহ্যজগৎ এবং মনােজগৎ সবই মিথ্যা । এদের কারও কোন সত্তা নেই । ফলে , দৃশ্যমান জগৎ শূন্য । নাগার্জুন এই মতের প্রতিষ্ঠাতা । 


যােগাচার মত খন্ডন : যােগাচার বৌদ্ধ সম্প্রদায় ভাববাদী হিসাবে তারা বিজ্ঞানকেই একমাত্র সৎ বলে মেনেছেন । বিজ্ঞানের বিষয় হিসাবে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই । কিন্তু মাধ্যমিক বৌদ্ধ মতে , জ্ঞেয় বিষয়ের অনস্তিত্বই জ্ঞাতা এবং জ্ঞানের অনস্তিত্ব প্রমাণ করে । কাজেই , বাহ্য জগৎ এবং মন কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই । সবই শূন্য, এবং শূন্যই একমাত্র সৎ । বাহ্যবস্তু এবং মন উভয়েই শত্তাহীন — এরূপ প্রমাণে মাধ্যমিকদের যুক্তি হল—

( ১ ) বাহ্য বস্তু থাকলে তা হয় অংশের সমষ্টি অথবা কোন অখণ্ড সমগ্র হবে । অংশের সমষ্টি হলে তা পরিণামে পরমাণু দ্বারা সৃষ্ট হবে । আর , পরমাণুর প্রত্যক্ষ হয় না বলে পরমাণু সংযােগে উৎপন্ন বস্তুটিরও প্রত্যক্ষহবে না । ফলে , বস্তুটিকে অস্তিত্বশীল বলা যাবে না । আর যদি অখণ্ড সত্তা হয় তাহলে খণ্ডের সাথে অখণ্ডের সম্বন্ধকে ব্যাখ্যা করা যাবে না । 

২ ) বস্তুটি ঘট হলে , ঘটটির অস্তিত্ব সব সময় ছিল অথবা পূর্বেছিল না — এই দুটি বিকল্পের একটিকে মানতে হবে । কিন্তু ঘটটি বিশেষ একটি সময়ের উৎপন্ন বস্তু এরকম বলা যায় না আর যদি দ্বিতীয় বিকল্পটির কথা বলা হয় তাহলে স্ববিরােধ হবে । কারণ , একই সাথে অস্তিত্বশীলতা এবং অস্তিত্বহীনতা গুণ দুটি একই ঘটে প্রয়ােগ করা হয় । 

৩ ) কোন বস্তুকে অন্য বস্তুর সাথে সম্বন্ধযুক্ত না করে জানা যায় না । কারণ , জাগতিক বস্তুমাত্রই আপেক্ষিক , আর আপেক্ষিক বস্তুর নিজস্ব কোনাে স্বভাব থাকে না । আর স্বভাবহীন বস্তু সত্তাহীন বলে জাগতিক বস্তুর সত্তা থাকতে পারে না । ফলে , যা কিছু বস্তুরূপে প্রত্যক্ষের বিষয় হয় সবই শূন্য — এটাই নাগার্জুনের মত । 


[         ] বুদ্ধদেব বলেছেন , জগতের আদিও নেই অনন্তও নেই — নাগার্জুন এর অর্থ করেছেন — জগৎ আদিতে , মধ্যকালে এবং অন্তে কোনাে সময়েই ছিল না । অর্থাৎ জগতের উৎপত্তি , স্থিতি ও বিনাশ নেই । কাজেই , জগৎ অযথার্থ । এমনকি জ্ঞান - জ্ঞতা সম্পর্ক , জ্ঞাতা , জ্ঞেয় বস্তু,কর্ম, কর্মকর্তা , কর্মফল , দেহ ও মন , দেশ ও কাল , গতি , কার্য কারণ ,চারটি আর্যসত্য , ভাবচক্র , দুঃখের নিবৃত্তি, নির্বাণ সবই মিথ্যা । সবই শূন্য । আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ বিভিন্ন সম্বন্ধ কর্তৃক সৃষ্ট এক অধ্যায় । কাজেই বাহ্যজগৎ , মনােজগৎ সবই মিথ্যা । সবই সত্তাহীন , শূন্য । মাধ্যমিকদের এরূপ মতই সর্ববৈনাশিকবাদ নামে পরিচিত । 



‘শূন্য’ কথাটি ব্যবহার করায় আপাতভাবে মনে হয় মাধ্যমিক বৌদ্ধগণ কোনকিছুরই অস্তিত্ব মানেননি । যদিও তাদের প্রতি এরূপ ধারণা সত্য নয় । কারণ , গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায় এই মত আসলে অলীকতাবাদ বা শূন্যবাদ নয় । একমাত্র দৃশ্যমান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকেই অলীক ও অবাস্তব বলা হয়েছে । কিন্তু এই জগতের অন্তরালে এক পরম সত্তার অস্তিত্ব আছে , যা ইন্দ্রিয়াতীত এবং যার প্রত্যক্ষ লব্ধ অভিজ্ঞতা দ্বারা ব্যাখ্যা সম্ভব নয় । কাজেই , মাধ্যমিক মতবাদে একদিকে অলৌকিক পরম সত্তা এবং অন্যদিকে লৌকিক বা ব্যবহারিক সত্তা স্বীকার করা হয়েছে । 


[          ] মাধ্যমিক বৌদ্ধরা প্রতীত্যসমুৎপাদবাদের সাহায্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সমস্ত বিষয়ের অস্তিত্বকে শূন্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন । তাদের মতে , কোনাে ঘটনাই কারণহীন নয় । প্রতিটি ঘটনাই পূর্ববর্তী কারণ দ্বারা সৃষ্টি হয় । আবার কোনাে কার্য উৎপন্ন না করে বিনাশও হয় না । যেহেতু সবই কার্য-কারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ । ফলে , প্রত্যক্ষগ্রাহ্য সমস্ত বস্তুই আপেক্ষিক । কোনাে কিছুই স্ব-নির্ভর নয় । আর , সমস্ত বস্তু আপেক্ষিক বলে সবই শূন্য । কাজেই , শূন্যবাদে  ‘শূন্য’ কথার অর্থহল আপেক্ষিক । 


চন্দ্রকীর্তি বলেছেন , জগৎ সৎ নয় । অসৎ নয় , এ সম্বন্ধে কিছুই বলা যায় না । সবই অনির্বচনীয় । এই মতবাদকে মাধ্যমিক বলার কারণ হল , এই মতবাদ বস্তুর নিত্যতা যেমন স্বীকার করে না তেমনি অনিত্যতাও স্বীকার করে না । বস্তুর অস্তিত্ব অন্য কারণের উপর নির্ভর করে । নাগার্জুন বলেছেন শূন্যবাদই হল মধ্যমপন্থা । 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন