উত্তর : আত্মা সম্পর্কে সাধারণ মত : সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে যে প্রত্যেকেরই একটি করে আত্মা আছে , যা নিত্য , শাশ্বত । এই আত্মা দেহ, ইন্দ্রিয়, মন ইত্যাদি থেকে পৃথক । কারণ দেহের বিনাশের পরেও আত্মা থেকে যায় । মৃত্যুর পর আত্মা পুনরায় অন্য দেহ ধারণ করে ।
বৌদ্ধ মতে আত্মা : বৌদ্ধ দর্শনের আত্মা সম্বন্ধীয় মতই নৈরাত্মবাদ বা অনাত্মবাদ । নৈরাত্ম্য বা অনাত্মবাদ অনুসারে নিত্য ও স্থায়ী আত্মার কোনাে অস্তিত্ব নেই । বৌদ্ধ দর্শনে অত্মার অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়নি । কারণ , নিত্য ও স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও বৌদ্ধ দর্শনে পরিবর্তনশীল আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে । বৌদ্ধ মতে , আমরা যাকে আত্মা বলি তা হল বিজ্ঞান সন্তান বা চেতনা -প্রবাহ । এই চেতনা প্রবাহ হল মানসিক প্রক্রিয়ার প্রবাহ । আমাদের মানসিক ক্রিয়াগুলি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল বলে আত্মাও পরিবর্তনশীল ও অনিত্য ।
আত্মা সম্পর্কে নাগসেনের মত : বৌদ্ধ দার্শনিক নাগসেন নিত্য ও স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব মানেননি । তিনি আত্মা প্রসঙ্গে রথের উপমা দিয়ে বলেছেন , রথ যেমন- চক্র ,অর ,দণ্ড প্রভৃতির সমষ্টি তেমনি আত্মাও রূপ , বেদনা , সংজ্ঞা , সংস্কার এবং বিজ্ঞানের সমাহার বা সমষ্টি । এগুলিকে বৌদ্ধ দর্শনে স্কন্ধ বলা হয় । তাই , এই পঞ্চ স্তন্ধের সমষ্টিই আত্মা । কোনাে কোনাে বৌদ্ধ এই পাঁচটির সমষ্টিকে আত্মা না বলে স্কন্ধ মাত্রকেই আত্মা বলেছেন ।
অনিত্য আত্মার ক্ষেত্রে আপত্তি : আত্মা অনিত্য ও মানসিক প্রক্রিয়ার প্রবাহ হলে মানসিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের সাথে আত্মার পরিবর্তনকেও স্বীকার করতে হবে । ফলে , শৈশব , যৌবন , বার্ধক্যের মধ্য দিয়ে যে অভিন্ন ব্যক্তির অস্তিত্ব তা কিভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে ? কিন্তু আমরা অনুভব করি যে শৈশবের আমি এবং বার্ধক্যের আমি এক ও অভিন্ন ।
আপত্তির উত্তর : এক্ষেত্রে , বুদ্ধদেব বলেছেন , প্রদীপ শিখা প্রতিটি ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন তেলকে দহন করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে বলে প্রতিটি ক্ষণেই আলােক শিখা পরস্পর ভিন্ন হলেও একই প্রদীপ শিখার প্রত্যক্ষ হয় তেমনি মানসিক প্রক্রিয়ার প্রবাহ বা ধারাবাহিকতার ফলে প্রতিটি ক্ষণের আত্মা ভিন্ন হলেও অভিন্ন আত্মার অস্তিত্বের বােধ হয় ।
দ্বিতীয় আপত্তি : আত্মা অনিত্য ও পরিবর্তনশীল হলে জন্মান্তর কিভাবে সম্ভব হবে ? কারণ , কর্ম -নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই নিজ নিজ কর্মের ফল ভােগ করতে হয় । আর এই কর্মফল ভােগ এই জন্মে শেষ না হলে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় অবশিষ্ট কর্মফল ভােগের জন্য । একেই জন্মান্তর বলে । কিন্তু, আত্মাই যদি অনিত্য হয় বা স্থায়ী সত্তা না থাকে তাহলে ওই অবশিষ্ট কর্মফল কে ভােগ করবে ?
অপত্তির উত্তর : এক্ষেত্রে বলা হয়েছে জন্মান্তরকে অস্বীকার করা যায় না । কারণ , বৌদ্ধ মতে , জলন্ত প্রদীপ থেকে যেমন অন্য প্রদীপ জ্বালানাে যায় তেমনি একটি জীবন থেকেও পরবর্তী জীবন সম্ভব ।
সমালােচনা : আত্মা মানসিক প্রক্রিয়ার প্রবাহ হলে স্মৃতি অসম্ভব হবে । কারণ , গতকাল আমি যা প্রত্যক্ষ করেছি আজকের আমি তা থেকে ভিন্ন হবে । ফলে একজন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করবে আর অন্য ব্যক্তি তা স্মরণ করবে — অর্থাৎ প্রত্যক্ষ কর্তা ও স্মরণ কর্তাকে ভিন্ন বলতে হবে যা অসম্ভব । কাজেই , স্থায়ী প্রত্যক্ষ কর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় ।
মূল্যায়ণ : বৌদ্ধ দর্শনে আত্মাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তার দ্বারা নিত্য, শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করা না গেলেও সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় ।কারণ ,স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব মেনে নিলে সহজেই স্মৃতি, প্রত্যাভিজ্ঞা ইত্যাদির ব্যাখ্যা সম্ভব হয় ।