‘কর্ম’ কী ? ‘কর্মযােগ’ বলতে কী বোঝ আলােচনা করাে

অনাস পাস দর্শন honours pass general philosophy questions answers প্রশ্নোত্তর কর্ম কী কর্মযােগ বলতে কী বোঝ আলােচনা করাে kormo ki kormoyog bolte ki bojho alochona koro questions answers


উত্তর : ‘কর্ম’ কী ? :  ‘কর্ম’ শব্দটি সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু থেকে এসেছে । ‘কৃ’ ধাতুর অর্থ ‘করা’ , যা কিছু  হয় তাই কর্ম । শব্দটির পারিভাষিক অর্থ ‘কর্মফল ’, ‘কর্ম’ শব্দটি কেবল কাজ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে । কর্ম প্রকৃতির ভিত্তির অংশবিশেষ । কর্মপ্রবাহ সবসময় বয়ে চলেছে । যারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী তারা আরও ভালােভাবে বুঝতে পারেন । কারণ , তারা জানেন ঈশ্বর এমন একজন অক্ষম পুরুষ নয় যে আমাদের সাহায্যে চাইবে । যে মানুষ যশ বা অন্য কোনাে অভিসন্ধি ব্যতীত কর্ম করেন তিনিই সর্বাপেক্ষা ভালাে কর্ম করেন । আরও বলা যায় ,জগতের উপকার করা — এই ব্যাপারটি কীরকম ? আমরা কি জগতের কোনাে উপকার করতে পারি ? উচ্চতম দৃষ্টি দিয়ে বললে বলতে হয় না ,যদি তা হত তাহলে আর এ জগৎ থাকত না । আমরা পাঁচ মিনিটের জন্য কোনাে ব্যক্তির ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পারি , কিন্তু আবার সে ক্ষুধার্ত হবে । আমরা মানুষকে যেসব সুখ দিতে পারি তা ক্ষণিকমাত্র । কেউই এই নিত্য আবর্তনশীল সুখ -দুঃখ, ব্যাধি, চিরকালের জন্য দূর করতে পারে না । 


কর্মযােগ : কর্মযােগ নিঃস্বার্থপরতা ও সৎকর্ম দ্বারা মুক্তি লাভ করার একটি ধর্ম বা নীতিপ্রণালী । যিনি কর্মযােগী তার কোনাে প্রকার ধর্মমতে বিশ্বাস করার প্রয়ােজন নেই । তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করতেও  পারেন । আত্মা সম্বন্ধে অনুসন্ধান না করতেও পারেন । অথবা , কোনাে প্রকার দার্শনিক বিচারও না করতে পারেন । কিছুই এসে যায় না ,তার বিশেষ উদ্দেশ্য নিঃস্বার্থপরতা লাভ করা এবং নিজের চেষ্টাতেই তা করা । তার জীবনের প্রতি মুহূর্তেই হবে এর উপলদ্ধি । কারণ ,জ্ঞানী যুক্তিবিচারের মাধ্যমে বা ভক্ত ভক্তির দ্বারা যে সমস্যার সমাধান করেছেন তাকে কোনাে প্রকার মতবাদের সাহায্য নিতে হয় না, কেবল কর্ম দ্বারাই সে সমস্যার সমাধান করেন । 


নিরন্তন কর্ম : গীতার মূল ভাব হল , নিরন্তন কর্ম করাে । কিন্তু তা আসক্তি শূন্য হতে হবে । মনকে যদি একটি হ্রদের সঙ্গে তুলনা করা হয় তবে বলা যায় , মনের মধ্যে যেসব তরঙ্গ ওঠে তা পুনরাবির্ভাব ঘটে । অপরের প্রতি আমাদের কর্তব্যের অর্থ হল অপরকে সাহায্য করা অর্থাৎ জগতের উপকার করা । এখন প্রশ্ন, কেন আমরা জগতের উপকার করব ? আপাতত বােধ হয় যে, আমরা জগতকে সাহায্য করছি বাস্তবিক কিন্তু নিজেদেরই সাহায্য করছি । 


মুক্তি : আমরা আগেই জেনেছি ‘কর্ম’ এই অর্থ ছাড়া ‘কর্ম’ শব্দ দ্বারা মনােবিজ্ঞানে কার্য - কারণভাবও বােঝানাে হয় । যেকোনাে কার্য বা যেকোনাে চিন্তা কোনাে কিছু ফলােৎপাদন করে । তাকেই কর্ম বলে ।সুতরাং ,কর্মবিধানের অর্থ কার্য-কারণের নিয়ম অর্থাৎ কারণ ও কার্যের অনিবার্য সম্বন্ধ । আমাদের ভারতীয় দর্শনের মতানুযায়ী এই ‘কর্মবিধান’ সমগ্র বিশ্বজগতের পক্ষেই সত্য ।



কর্মযােগের আদর্শ : বেদান্তধর্মের মহান ভাব হল ,আমরা বিভিন্ন পথে সেই একই চরম লক্ষ্যে , উপনীত হতে পারি । এই পথগুলি চারটি বিভিন্ন উপায়ে বর্ণনা করা , যথা – কর্ম , ভক্তি যােগ ও জ্ঞান যায়  । যার অন্য কোনাে শক্তি নেই সে শুধু ভক্ত ছাড়া কিছুই নয় ,অথবা এটি জ্ঞান ছাড়া কিছুই নয় । দেখা যায় শেষপর্যন্ত এই চারটি পথই একই ভাবের অভিমুখী হয়ে মিলিত হয় । সকল ধর্ম এবং সাধন প্রণালী আমাদের এই চরম লক্ষ্যে নিয়ে যায় । 


মূল্যায়ন : আমরা যদি নিজ নিজ জীবন বিশ্লেষণ করি , তাহলে দেখতে পাই যে , আমাদের দুঃখের সবচেয়ে বড়াে কারণ এই , আমরা কোনাে কার্যগ্রহণ করে তাতে আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়ােজিত করি , হয়ত তা নিষ্ফল হল কিন্তু আমরা পরিত্যাগ করতে পারি না । আমরা জানি কর্ম আমদের আঘাত দিচ্ছে, কর্মের প্রতি আরও বেশি আসক্তি আমাদের কেবল দুঃখই দিচ্ছে । তথাপি আমরা ওই কর্ম থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে পারি না । মৌমাছি মধু পান করতে এল ,কিন্তু তার পাগুলি মধুভান্ডারে আটকে গেল । সে বের করতে পারল না । বারবারই আমাদের এই দূরাবস্থা হচ্ছে । 


কেন আমরা জগতে এসেছি ? আমরা এখানে মধুপান করতে এসেছিলাম , কিন্তু দেখতে পাচ্ছি আমাদের হাত পা এতে আবদ্ধ হয়ে গেছে । আমরা জগতকে ধরতে এসেছিলাম , কিন্তু নিজেরাই ধরা পড়ে গেছি । ভােগ করতে এসেছিলাম ,কিন্তু নিজেরাই ভুক্ত হয়েছি । শাসন করতে এসেছিলাম , নিজেরাই শাসিত হয়েছি । কাজ করতে এসেছিলাম , কিন্তু অন্যের হাতের পুতুল হয়ে পড়েছি । 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন