উত্তর : অধিবিদ্যার ইংরাজি প্রতিশব্দহল Metaphysics । এটি এসেছে Meta এবং Physics দুটি শব্দ থেকে । Meta শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল পরে ,আর Physics ' শব্দের বাংলা করা হয়েছে পদার্থবিদ্যা । কাজেই , আক্ষরিক অর্থে Metaphysics -এর অর্থ যা কিছু পদার্থবিদ্যার পরে আসে । অধিবিদ্যার আলােচ্য বিষয় ভৌতিক জগতের অতিবর্তী । ঈশ্বর, আত্মা , অমরতা , স্বর্গ নরক ইত্যাদি বিষয়গুলিই মুখ্যত অধিবিদ্যায় আলােচিত হয় । কাজেই , ভারতীয় দর্শনে অধিবিদ্যা বলতে বােঝায় সেই বিজ্ঞানকে যেখানে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভৌতিক জগতের অতিবর্তী বিষয় নিয়ে আলােচনা করা হয় । যেমন — ঈশ্বর , আত্মা অমরত্ব ইত্যাদি ।
চার্বাক জড়বাদ : জড়বাদ অধ্যাত্মবিরােধী একটি মতবাদ , যেখানে জড়কেই জগতের মূলতত্ত্ব বা উপাদান বলে স্বীকার করা হয় । জড়বাদ অনুযায়ী এই জগতে জড়েরই অস্তিত্ব আছে । অজড় কোনাে বিষয় নেই । ভারতীয় দর্শনের জড়বাদ বলতে চার্বাক দর্শনের দার্শনিক মতবাদকেই বােঝায় । কারণ চার্বাকরা জড়কেই যাবতীয় বিষয়ের মূলতত্ত্ব বা উপাদান বলে মেনেছেন ।
ভূত চতুষ্টয় : আপাতভাবে আমরা আত্মা , মন , প্রাণ প্রভৃতি যেগুলিকে অজড় বলে মনে করি চার্বাক মতে সেগুলিও জড় অথবা জড়ভূতের সমন্বয়ে গঠিত বিষয় । চার্বাক দর্শনে অনুযায়ী এই জগৎ এবং জাগতিক বস্তু সমূহের মূল উপাদান হল ভূত । ভারতীয় দর্শনে ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ এবং ব্যোম বা আকাশ নামে পঞ্চভূত স্বীকার করা হয় । কিন্তু জড়বাদী চার্বাকরা প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ বলায় পঞ্চম ভূত অর্থাৎ ব্যোম্ বা আকাশের অস্তিত্ব মানেন না । তাই চার্বাক মতে ভূত চারটি —ক্ষিতি , অপ , তেজ ও মরুৎ ।
স্বভাববাদ : চার্বাক মতে ক্ষিতি প্রভৃতি চারটি ভূতই জগতের মূল তত্ত্ব এই চারটি দ্বারাই জগৎ ও জাগতিক সকল বস্তু সমূহের সৃষ্টি । কিন্তু ভূত চারটি জড় হওয়ায় তারা কিভাবে নিমিত্ত কারণ ছাড়াই জগৎ ও জাগতিক বিষয় সৃষ্টি করবে তার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ভূত চারটি জড় হলেও এদের নিজস্ব অন্তর্নিহিত স্বভাব দ্বারা ভূতগুলি নিজেদের মধ্যে মিলিত হয়ে যাবতীয় বস্তু ও বৈচিত্র্যময় জগৎ সৃষ্টি করে ।
ভূতচৈতন্যবাদ : চার্বাক মতে আমরা সাধারণভাবে বিশ্বাস করি যে আত্মা দেহাতিরিক্ত এবং সেহেতু মৃত্যুর পরেও আত্মার অস্তিত্ব থাকে । কিন্তু, চার্বাক মতে , দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব কখনও কোথাও কারও প্রত্যক্ষের বিষয় হয়নি । কাজেই , দেহাতিরিক্ত আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই । আমরা যাকে আত্মা বলি তা হল চৈতন্য বিশিষ্ট দেহ । যে দেহে চেতনা থাকে সেই দেহই আত্মা । চৈতন্য হল দেহেরই একটি বিশেষ গুণ । এটি অজড় কোন তত্ত্ব নয় । ক্ষিতি অপ , তেজ ও মরুৎ চারটি জড়ভূতের নির্দিষ্ট পরিমাণ মিশ্রণের মধ্য দিয়ে চৈতন্য নামক একটি নতুন গুণের আবির্ভাব ঘটে । আবার ,মৃত্যুর পর দেহের বিনাশের সাথে আত্মারও বিনাশ ঘটে ।
আধ্যাত্মবাদের বিরােধিতা : জড়বাদ মূলত আধ্যাত্মবিরােধী একটি মতবাদ । কাজেই , ঈশ্বর , আত্মা , আত্মার অমরতা , স্বর্গ নরক ইত্যাদি বিষয়গুলির বিরােধিতা করা হয়েছে । চার্বাক মতে , আত্মা এবং দেহ অভিন্ন । কারণ , দেহ ভিন্ন আত্মা বা চৈতন্যের কোন অস্তিত্ব নেই । ঈশ্বর প্রত্যক্ষের বিষয় নয় বলে জগৎ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিমিত্ত কারণ রূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে । বেদ সম্পর্কে চার্বাক মত হল , এটি ভণ্ড , ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন শ্রেণির ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থে জীবিকার্জনের প্রয়ােজনে বেদ রচনা করেছেন । ফলে , বেদ কোন প্রামাণ্য গ্রন্থ নয় । স্বর্গ নরক , পাপ পুণ্য বলেও কিছু নেই সাধারণ অজ্ঞ মানুষকে এগুলির ভয় দেখিয়ে ব্রাহ্মণরা নিজেদের স্বার্থে যাগ যজ্ঞের বিধান দিতেন ।
জন্মান্তর : চার্বাক মতে , ‘জন্মান্তর’ অর্থাৎ অন্য জন্ম , আবার পরবর্তী দেহধারণকেই জন্মান্তর বলে । কিন্তু,আত্মার দেহাতিরিক্ত কোন সত্তা থাকে না , দেহের বিনাশের সাথেই আত্মারও বিনাশ ঘটে । আর , দেহাবসানের মধ্য দিয়ে আত্মারও বিনাশ ঘটে বলে আত্মার পরবর্তী জন্ম বা জন্মান্তরের কোন সম্ভাবনা থাকে না ।
মােক্ষ : ভারতীয় দর্শনে মােক্ষকে পরম পুরুষার্থ বলা হলেও চার্বাক মতে , মৃত্যুই মুক্তি । কারণ , মৃত্যুর পর আত্মা কোনাে অস্তিত্ব থাকে না । কাজেই , আত্মার পৃথক ভাবে মুক্তির প্রশ্নই ওঠে না ।
মূল্যায়ণ : চার্বাক দর্শন জড়বাদী ও প্রত্যক্ষবাদী হিসাবে অধিবিদ্যক সমস্ত বিষয়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন । কারণ , অধিবিদ্যার বিষয়গুলিকে প্রত্যক্ষ করা যায় না । কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে চার্বাকগণ যেভাবে অজড় আধ্যাত্ম তত্ত্বসমূহের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সর্বতােভাবে গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হয় না । বিশেষত চার্বাকদের , দেহাত্মবাদ , ভূতচৈতন্যবাদ , নিরীশ্বরবাদ প্রভৃতি বিভিন্ন ভাবে সমালােচিত হয়েছে । কিন্তু, চার্বাকদের জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অধ্যাত্মবিরােধী যে আলােচনা ভারতীয় দর্শনে তার গুরুত্বকে কোনভাবেই অস্বীকার কার যায় না ।