উত্তর :
খাঁচার পাখি ছিল সােনার খাঁচাটিতে ,
বনের পাখি ছিল বনে
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে
কী ছিল বিধাতার মনে ।
জীবসত্তা : রবীন্দ্রনাথ মানব প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে , মানব প্রকৃতিতে দ্বৈত সত্তা আছে তা হল — জীবসত্তা ও মানবসত্তা । দেহ ইন্দ্রিয় নিয়ে মানুষের জৈবিক সত্তা গঠিত । এই দিক থেকে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনাে পার্থক্য নেই । জীবসত্তার ধর্ম,জৈবিক ধর্ম ও জৈবিক প্রকৃতির ধর্ম । মানুষের মধ্যে একত্রে যেন দেবতা ও দানবের অবস্থান । মানুষের এই সত্তাকে বলা হয় অহং সত্তা । দৈহিক সুখ অর্জনের জন্য ও জৈবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থতার জন্য অহংসত্তা যান্ত্রিকভাবে কর্ম করতে বাধ্য হয় । এই অহং সত্তার পরিচয় হয় আমার রূপ , দেহ , সম্পদ দিয়ে । দৈহিক চাহিদা কখনও পূরণ হয় না । উত্তরােত্তর বাড়তেই থাকে । পরিণামে আসে দুঃখ অশান্তি । রবীন্দ্রনাথ মানুষের এই জীবসত্তাকে মানব প্রকৃতির সীমাবদ্ধ দিক বলেছেন ।
মানবসত্তা : মানুষের মধ্যে আর একটি সত্তা হল মানবসত্তা । এই মানব সত্তার প্রকাশ মানবতার মধ্য দিয়ে । এই মানব সত্তার জয়যাত্রা শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ মানবতার জয়গান গেয়েছেন । বিজয় রথের জয়মাল্য পরিয়ে দিয়েছেন মানুষের গলায় । ক্ষুদ্রগণ্ডী ছাড়িয়ে মানুষের উত্তরণ ঘটেছে বৃহতের আহ্বানে ।
“হেথা নয়, হােতা নয় , অন্য কোথা
অন্য কোন খানে”........................
অতৃপ্ত মানবাত্মা সুদূরের পিয়াসী, অজানার আহ্বানে উৎসর্গীকৃত প্রাণ । মানুষ আপন অন্তরে অর্থ সেই অর্থ হল মানুষ মহৎ । মানুষকে প্রমাণ করতে হবে যে সে মহৎ । তাহলেই প্রমাণ হয়ে যাবে , সে মহৎ । মহৎ হলে মানুষ খুঁজে পাবে তার দেবতাকে , এই দেবতাই মানুষের ‘মনের মানুষ’ ।
আরও ভাবনা : সৃষ্টি বিবর্তনের শুরুর পর্যায়ে জীবদেহের আবির্ভাব । পরবর্তী পর্যায়ে এল মানুষ । প্রাধান্য পেল দেহ আশ্রিত মন ও আত্মার বিচিত্ৰগতি । দেহে দেহে প্রত্যেকটি জীব স্বতন্ত্র । অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চলছে শুধুই প্রতিযােগিতা কিন্তু ‘মানুষ’ জীবটির দেহ ছাড়াও আছে মন । মানুষের সত্তা দ্বি বিধ । তার যে সত্তা জীবনসীমার মধ্যে যেখানে যেটুকু প্রয়ােজন । সেইটুকুতেই তার সুখ । কিন্তু অন্তরে অন্তরে জীব মানব বিশ্ব মানবের প্রসারিত । সেই দিকে সে সুখ চায় না । সুখ বেশি চায় । মানুষ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে — ‘তুমি আছাে কোথায় ? উত্তর আসে — প্রত্যক্ষতঃ দেহধর্মে ‘এই আমি’ অপ্রত্যক্ষত অন্তরে ‘সেই আমি’ মানুষ আপন অন্তরে অর্থ খুঁজছে । সেই অর্থ হল —মানুষ মহৎ মানুষকে প্রমাণ করতে হবে যে সে মহৎ । তাহলেই প্রমাণ হয়ে যাবে , সে মহৎ । মহৎ হলেই মানুষ খুঁজে পাবে তার দেবতাকে । এই দেবতাই মানুষের ‘মনের মানুষ’ । উপনিষদে ‘এ ’ এবং ‘ উনি ’ — দু এর কথা আছে । ‘এ’ হল আমি । অর্থাৎ এই ‘তিনি’ নিছক বাইরের তত্ত্বমাত্র নন । তিনি হলেন আমার ‘আমার আমি’ আমার মনের মানুষ ।
বিরােধের অবসান : মনুষ্যত্ব অর্জনই মানুষের চরম লক্ষ্য । বিশ্বাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনই চরম লক্ষ্য । এই বিশ্বাত্মা সকল মানুষের আত্মা । এই বিশ্বাত্মা হলেন ঈশ্বর । ঈশ্বর সকল মানুষের হৃদয়ে বিরাজমান । তাই সকল মানুষই হলেন ঈশ্বর । প্রত্যেক মানুষের উচিত ঈশ্বর মনে করে সকল মানুষের সেবা করা , পূজা করা , আরাধনা ও সকল মানুষের কল্যাণে কাজ করা । অহিংসা , প্রেম , ভালবাসা ও মানুষের সেবাই হল শ্রেষ্ঠ ধর্ম, এর ফলে মানুষের জৈবিক ধর্ম বিলীপ্ত হয়ে যাবে । মানবধর্ম বিকশিত হবে । মানব মহামানব হয়ে উঠবে ।