ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে প্রচলিত মতবাদগুলি ইকবাল কিভাবে খণ্ডন করেছেন ?

অনাস পাস দর্শন honours pass general philosophy questions answers প্রশ্নোত্তর ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে প্রচলিত মতবাদগুলি ইকবাল কিভাবে খণ্ডন করেছেন eswarer astitto promane procholito motobadguli ikbal kivabe khondon korechen questions answers


উত্তর : শুরুর কথা : ধার্মিক বা ধর্ম বিশ্বাসীরা ঈশ্বর সম্বন্ধে এই ধারণায় বিশ্বাসী যে , ঈশ্বর নিরাকার , চৈতন্যময় , পরম পুরুষ । অতীত কিংবা বর্তমানে প্রচলিত প্রধান ধর্মমতগুলি পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে কোনও না কোনও আকারে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস ঐ সকল ধর্ম বিশ্বাসীদের অধিকাংশের একটি অঙ্গ । ঈশ্বরকে আমাদের পঞ্চ কর্ম ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কোন জড় দ্রব্যের মত প্রত্যক্ষ করা না গেলেও বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সাধনের জন্য কতকগুলি প্রমাণের উল্লেখ করেন । তবে সঠিক অর্থে, সেগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্বসাধক প্রমাণ না বলে অস্তিত্বসাধক যুক্তি বলাই ভাল । কারণ , ধর্মের ঈশ্বরকে যদি পরম পুরুষ বা  সত্তারূপে গণ্য করা হয় অর্থাৎ ঈশ্বর বিশ্বাসীরা যা করে থাকেন তা ঐ পরমপুরুষ বা পরম সত্তা প্রমাণ সাপেক্ষ হতে পারে না , তা হবে প্রমাণ নিরপেক্ষ । ঐ পরম পুরুষ বা পরম সত্তার অস্তিতের সমর্থনে কতকগুলি যুক্তি প্রদর্শন করা যেতে পারে , যদিও সেই যুক্তির দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সিদ্ধ বা প্রমাণিত হয় না ।কিন্তু প্রমাণরূপে তেমন মূল্যবান না হলেও যুক্তি হিসাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বসাধক যুক্তিগুলি মূল্যবান । 



পরিকল্পনামূলক বা উদ্দেশ্যমূলক যুক্তি : উদ্দেশ্যমূলক যুক্তির সার কথা হল , এই জন্য এক সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনামাফিক জগৎ — জগতের নিয়মশৃঙ্খলা , সামঞ্জস্য , ঐক্য ইত্যাদি ব্যাখ্যার জন উদ্দেশ্যসাধক এক অনন্ত জ্ঞান ও ধীশক্তিসম্পন্ন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় । উদ্দেশ্যমূলক যুক্তির সমর্থক হলেন ব্রাডলি, বােসাঙ্ক , উইলিয়াম প্যালে , মার্টিনিউ প্রমুখ দার্শনিকগণ । উদ্দেশ্যমূলক মতবাদ প্রসঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর ধর্মতাত্ত্বিকরূপে পরিচিত উইলিয়াম প্যালের অভিমত স্ববিশেষ উল্লেখযােগ্য । প্যালে সমগ্র জগৎকে এক বিরাট ও জটিল যন্ত্ররূপে উল্লেখ করে বলেন — এই জগৎ হল প্রভূত পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য সাধকতার নিদর্শন । একটি শিলাখণ্ড প্রাকৃতিক নিয়মে , উদ্দেশ্যহীনভাবে , আকস্মিকভাবে উৎপন্ন হতে পারে , কিন্তু কোন পরিকল্পনা না থাকলে কোন উদ্দেশ্যসাধনের উদ্দেশ্য না থাকলে একটা ঘড়ি নির্মিত হতে পারে না । পরিকল্পনা উদ্দেশ্যসাধকতার নিদর্শনস্বরূপ প্যালে বিশেষ মানুষের মস্তিষ্ক লক্ষ্য লক্ষ্য স্নায়ু ও কোন এমন এক সুসংহত বা সুশৃঙ্খলা ক্রিয়া করে , যাকে আকস্মিক বলা যায় না ।  



বিরুদ্ধ ইকবাল : উদ্দেশ্যবাদীরা জগতের মধ্যে পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্যসাধকতার নিদর্শন উল্লেখ করে এক অনন্ত ধীশক্তিসম্পন্ন উদ্দেশ্য সাধক রূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করেন । ইকবাল এর অভিমত হল জগতের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা , সামঞ্জস্য , ঐক্য ইত্যাদি স্বীকার করা গেলেও তাদের ব্যাখ্যা করার জন্য ঈশ্বরের স্বীকৃতি প্রয়ােজন হয় না । 


লক্ষণভিত্তিক যুক্তি : তত্ত্ববিষয়ক যুক্তির মূল বক্তব্য হল ঈশ্বরের ধারণার মধ্যেই ঈশ্বরের বাস্তবতা নিহিত । তত্ত্ববিষয়ক যুক্তির উল্লেখযােগ্য উপস্থাপক হলেন অ্যাসেলম্ এবং দেকার্ত । নীচে দেকার্তের ঈশ্বর তত্ত্ব বিষয়ক যুক্তিটি আলােচিত হল — 


প্রথম যুক্তি : পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় পরে অ্যানসেলমের যুক্তির অনুরূপ যুক্তি উপস্থাপিত করেন ফরাসী দার্শনিক দেকার্ত । দেকার্ত মনে করেন যে , অ্যাসেলেমেব তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটি দোষযুক্ত । অ্যাসেলমের যুক্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বাস্তবতা অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রমাণিত হয়নি । দেকার্তের মতে , অ্যানসেলমের প্রমাণ থেকে তার প্রমাণ ভিন্ন । পূর্ণতম সত্তা ঈশ্বরের ধারণা থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবীভাবে নিঃসৃত হয় না । ঈশ্বরের ধারণার মধ্যে কেবল যে অস্তিত্বের সম্ভাবনা নিহিত আছে তা নয় , অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব ঈশ্বরের পূর্ণতম সত্তার ধারণার অন্তর্ভুক্ত । 


দ্বিতীয় যুক্তি : প্রতিটি কার্যেরই একটি কারণ আছে । নিছক শূন্য থেকে কোন কিছুর সৃষ্টি হতে পারে না — এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ বচন । কাজেই ঈশ্বরের ধারণারও একটি কারণ আছে । 


তৃতীয় যুক্তি : তৃতীয় যুক্তিটি প্রায় দ্বিতীয় যুক্তির মতই । এই যুক্তির ক্ষেত্রে দেকার্ত নিজের অপূর্ণতা এবং সেই অপূর্ণতার জ্ঞান থেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করতে চান । দার্শনিক ইকবাল এর বিরুদ্ধে দুটি স্তরে সমালােচনা করেছেন । যথা – 


প্রথম স্তর : ঈশ্বরের ধারণার মধ্যেই বিশ্লেষণগতভাবে অস্তিত্বের ধারণা নিহিত , যেভাবে তিনটি কোণের ধারণা বিশ্লেষণগতভাবে তিনটি দিক দিয়ে পরিবেষ্টিত সমতলের ধারণা প্রত্যয়ের মধ্যেই নিহীত । প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিধেয়টি অনিবার্যভাবে উদ্দেশ্যর সঙ্গে সম্পৃক্ত । একই বিষয় একটি পরম অনিবার্য সত্তার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে । 


দ্বিতীয় স্তর : অস্তিত্বের ধারণা যা ত্রিভূজের ধারণার মত একটি বিধেয় এবং এর উপস্থিতি কারও মধ্যে থাকতেও পারে অথবা নাও থাকতে পারে । দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় ,কাল্পনিক একশ ডলার ও বস্তুত একশ ডলারের সমসংখ্যক ডলার দিয়ে গঠিত অর্থাৎ মুদ্রার সংখ্যা একক । ডলারের বস্তুত অস্তিত্বআছে , একথা বলার মানেই হল যে ডলার প্রত্যয়টি ব্যবহারিক জগতে মূর্ত বা দৃষ্টান্তগত ভিত্তি রয়েছে । 




কারণ বিষয়ক যুক্তি : অ্যাকুইনাস্ বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ক যুক্তিতে জগতের সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান । জগতের ক্ষুদ্র বৃহৎ, যাবতীয় বস্তু এবং ঘটনাসাপেক্ষ , অন্য নির্ভর , সম্ভাব্য অর্থাৎ আপতিক । আপতিক বস্তু মাত্রই পরের ওপর নির্ভরশীল । অর্থাৎ আপতিক বস্তুর অস্তিত্ব জগতের কাছে আবশ্যিক নয় — বস্তুটি যেমন থাকতে পারে , তেমনি না থাকলেও জগতের কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না । যেমন — ‘ছাপানাে বইয়ের পাতা ’ ছাপানাে বইয়ের পাতাটি একাধিক বিষয়ের ওপর , তাদের বিভিন্ন ধরনের কার্যকারিতার ওপর নির্ভরশীল । যথা — বৃক্ষ, বৃক্ষচ্ছেদন , কাষ্ঠ পরিবহন , প্রকাশক , মুদ্রণকর্তা, লেখক , কালি , কলম ইত্যাদি । কার্য কারণ নীতির দিক থেকে ব্যক্ত করতে গেলে বলতে হয় , এই হল  সেই যুক্তি , যা অনিবার্যভাবে অস্তিত্বশীল নয়, তা অস্তিত্বের জন্য অপরের ওপর নির্ভরশীল । কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত শান্ত এবং অসীম বস্তু যেহেতু সম্ভাব্য এবং অপর্যাপ্ত সেহেতু সম্ভাব্য বস্তুর অস্তিত্বের কারণ তার মধ্যে নিহিত নয় । নানা কারণে ইকবাল বিশ্বতাত্ত্বিক যুক্তিটি গ্রহণ করেননি । কারণগুলি হল —  

( ১ ) যুক্তিটিতে ঈশ্বরকে জগতের অতিবর্তীরূপে গণ্য করা হয়েছে । ঈশ্বর জগতের অতিবর্তী হলে সেই ঈশ্বরকে আর সর্বধারক , সর্বব্যাপক প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না । 


( ২ )জগতকে ‘আপতিক’ বা ‘সাপেক্ষ’ এবং ঈশ্বরকে ‘আবশ্যিক’ বা ‘নিরপেক্ষ’ রূপে গণ্য করলেও অ্যাকুইনাস সঠিক কাজ করেননি । এখানে ঈশ্বর যদি আবশ্যিক হন তাহলে ‘ঈশ্বর’ হয়ে যাবে পরিনিয়ন্ত্রিত সত্তা । 


শেষকথা : উপরের আলােচনা থেকে দেখা গেল ইকবাল অত্যন্ত জোরালাে যুক্তির দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছেন এবং ইকবাল দৃঢ়তার সাথে ঘােষণা করেছেন স্বজ্ঞা মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন