উত্তর : শুরুর কথা : ধার্মিক বা ধর্ম বিশ্বাসীরা ঈশ্বর সম্বন্ধে এই ধারণায় বিশ্বাসী যে , ঈশ্বর নিরাকার , চৈতন্যময় , পরম পুরুষ । অতীত কিংবা বর্তমানে প্রচলিত প্রধান ধর্মমতগুলি পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে কোনও না কোনও আকারে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস ঐ সকল ধর্ম বিশ্বাসীদের অধিকাংশের একটি অঙ্গ । ঈশ্বরকে আমাদের পঞ্চ কর্ম ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কোন জড় দ্রব্যের মত প্রত্যক্ষ করা না গেলেও বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সাধনের জন্য কতকগুলি প্রমাণের উল্লেখ করেন । তবে সঠিক অর্থে, সেগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্বসাধক প্রমাণ না বলে অস্তিত্বসাধক যুক্তি বলাই ভাল । কারণ , ধর্মের ঈশ্বরকে যদি পরম পুরুষ বা সত্তারূপে গণ্য করা হয় অর্থাৎ ঈশ্বর বিশ্বাসীরা যা করে থাকেন তা ঐ পরমপুরুষ বা পরম সত্তা প্রমাণ সাপেক্ষ হতে পারে না , তা হবে প্রমাণ নিরপেক্ষ । ঐ পরম পুরুষ বা পরম সত্তার অস্তিতের সমর্থনে কতকগুলি যুক্তি প্রদর্শন করা যেতে পারে , যদিও সেই যুক্তির দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সিদ্ধ বা প্রমাণিত হয় না ।কিন্তু প্রমাণরূপে তেমন মূল্যবান না হলেও যুক্তি হিসাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বসাধক যুক্তিগুলি মূল্যবান ।
পরিকল্পনামূলক বা উদ্দেশ্যমূলক যুক্তি : উদ্দেশ্যমূলক যুক্তির সার কথা হল , এই জন্য এক সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনামাফিক জগৎ — জগতের নিয়মশৃঙ্খলা , সামঞ্জস্য , ঐক্য ইত্যাদি ব্যাখ্যার জন উদ্দেশ্যসাধক এক অনন্ত জ্ঞান ও ধীশক্তিসম্পন্ন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় । উদ্দেশ্যমূলক যুক্তির সমর্থক হলেন ব্রাডলি, বােসাঙ্ক , উইলিয়াম প্যালে , মার্টিনিউ প্রমুখ দার্শনিকগণ । উদ্দেশ্যমূলক মতবাদ প্রসঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর ধর্মতাত্ত্বিকরূপে পরিচিত উইলিয়াম প্যালের অভিমত স্ববিশেষ উল্লেখযােগ্য । প্যালে সমগ্র জগৎকে এক বিরাট ও জটিল যন্ত্ররূপে উল্লেখ করে বলেন — এই জগৎ হল প্রভূত পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য সাধকতার নিদর্শন । একটি শিলাখণ্ড প্রাকৃতিক নিয়মে , উদ্দেশ্যহীনভাবে , আকস্মিকভাবে উৎপন্ন হতে পারে , কিন্তু কোন পরিকল্পনা না থাকলে কোন উদ্দেশ্যসাধনের উদ্দেশ্য না থাকলে একটা ঘড়ি নির্মিত হতে পারে না । পরিকল্পনা উদ্দেশ্যসাধকতার নিদর্শনস্বরূপ প্যালে বিশেষ মানুষের মস্তিষ্ক লক্ষ্য লক্ষ্য স্নায়ু ও কোন এমন এক সুসংহত বা সুশৃঙ্খলা ক্রিয়া করে , যাকে আকস্মিক বলা যায় না ।
বিরুদ্ধ ইকবাল : উদ্দেশ্যবাদীরা জগতের মধ্যে পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্যসাধকতার নিদর্শন উল্লেখ করে এক অনন্ত ধীশক্তিসম্পন্ন উদ্দেশ্য সাধক রূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করেন । ইকবাল এর অভিমত হল জগতের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা , সামঞ্জস্য , ঐক্য ইত্যাদি স্বীকার করা গেলেও তাদের ব্যাখ্যা করার জন্য ঈশ্বরের স্বীকৃতি প্রয়ােজন হয় না ।
লক্ষণভিত্তিক যুক্তি : তত্ত্ববিষয়ক যুক্তির মূল বক্তব্য হল ঈশ্বরের ধারণার মধ্যেই ঈশ্বরের বাস্তবতা নিহিত । তত্ত্ববিষয়ক যুক্তির উল্লেখযােগ্য উপস্থাপক হলেন অ্যাসেলম্ এবং দেকার্ত । নীচে দেকার্তের ঈশ্বর তত্ত্ব বিষয়ক যুক্তিটি আলােচিত হল —
প্রথম যুক্তি : পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় পরে অ্যানসেলমের যুক্তির অনুরূপ যুক্তি উপস্থাপিত করেন ফরাসী দার্শনিক দেকার্ত । দেকার্ত মনে করেন যে , অ্যাসেলেমেব তত্ত্ববিষয়ক যুক্তিটি দোষযুক্ত । অ্যাসেলমের যুক্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বাস্তবতা অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রমাণিত হয়নি । দেকার্তের মতে , অ্যানসেলমের প্রমাণ থেকে তার প্রমাণ ভিন্ন । পূর্ণতম সত্তা ঈশ্বরের ধারণা থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবীভাবে নিঃসৃত হয় না । ঈশ্বরের ধারণার মধ্যে কেবল যে অস্তিত্বের সম্ভাবনা নিহিত আছে তা নয় , অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব ঈশ্বরের পূর্ণতম সত্তার ধারণার অন্তর্ভুক্ত ।
দ্বিতীয় যুক্তি : প্রতিটি কার্যেরই একটি কারণ আছে । নিছক শূন্য থেকে কোন কিছুর সৃষ্টি হতে পারে না — এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ বচন । কাজেই ঈশ্বরের ধারণারও একটি কারণ আছে ।
তৃতীয় যুক্তি : তৃতীয় যুক্তিটি প্রায় দ্বিতীয় যুক্তির মতই । এই যুক্তির ক্ষেত্রে দেকার্ত নিজের অপূর্ণতা এবং সেই অপূর্ণতার জ্ঞান থেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করতে চান । দার্শনিক ইকবাল এর বিরুদ্ধে দুটি স্তরে সমালােচনা করেছেন । যথা –
প্রথম স্তর : ঈশ্বরের ধারণার মধ্যেই বিশ্লেষণগতভাবে অস্তিত্বের ধারণা নিহিত , যেভাবে তিনটি কোণের ধারণা বিশ্লেষণগতভাবে তিনটি দিক দিয়ে পরিবেষ্টিত সমতলের ধারণা প্রত্যয়ের মধ্যেই নিহীত । প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিধেয়টি অনিবার্যভাবে উদ্দেশ্যর সঙ্গে সম্পৃক্ত । একই বিষয় একটি পরম অনিবার্য সত্তার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে ।
দ্বিতীয় স্তর : অস্তিত্বের ধারণা যা ত্রিভূজের ধারণার মত একটি বিধেয় এবং এর উপস্থিতি কারও মধ্যে থাকতেও পারে অথবা নাও থাকতে পারে । দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় ,কাল্পনিক একশ ডলার ও বস্তুত একশ ডলারের সমসংখ্যক ডলার দিয়ে গঠিত অর্থাৎ মুদ্রার সংখ্যা একক । ডলারের বস্তুত অস্তিত্বআছে , একথা বলার মানেই হল যে ডলার প্রত্যয়টি ব্যবহারিক জগতে মূর্ত বা দৃষ্টান্তগত ভিত্তি রয়েছে ।
কারণ বিষয়ক যুক্তি : অ্যাকুইনাস্ বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ক যুক্তিতে জগতের সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান । জগতের ক্ষুদ্র বৃহৎ, যাবতীয় বস্তু এবং ঘটনাসাপেক্ষ , অন্য নির্ভর , সম্ভাব্য অর্থাৎ আপতিক । আপতিক বস্তু মাত্রই পরের ওপর নির্ভরশীল । অর্থাৎ আপতিক বস্তুর অস্তিত্ব জগতের কাছে আবশ্যিক নয় — বস্তুটি যেমন থাকতে পারে , তেমনি না থাকলেও জগতের কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না । যেমন — ‘ছাপানাে বইয়ের পাতা ’ ছাপানাে বইয়ের পাতাটি একাধিক বিষয়ের ওপর , তাদের বিভিন্ন ধরনের কার্যকারিতার ওপর নির্ভরশীল । যথা — বৃক্ষ, বৃক্ষচ্ছেদন , কাষ্ঠ পরিবহন , প্রকাশক , মুদ্রণকর্তা, লেখক , কালি , কলম ইত্যাদি । কার্য কারণ নীতির দিক থেকে ব্যক্ত করতে গেলে বলতে হয় , এই হল সেই যুক্তি , যা অনিবার্যভাবে অস্তিত্বশীল নয়, তা অস্তিত্বের জন্য অপরের ওপর নির্ভরশীল । কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত শান্ত এবং অসীম বস্তু যেহেতু সম্ভাব্য এবং অপর্যাপ্ত সেহেতু সম্ভাব্য বস্তুর অস্তিত্বের কারণ তার মধ্যে নিহিত নয় । নানা কারণে ইকবাল বিশ্বতাত্ত্বিক যুক্তিটি গ্রহণ করেননি । কারণগুলি হল —
( ১ ) যুক্তিটিতে ঈশ্বরকে জগতের অতিবর্তীরূপে গণ্য করা হয়েছে । ঈশ্বর জগতের অতিবর্তী হলে সেই ঈশ্বরকে আর সর্বধারক , সর্বব্যাপক প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষিত করা যায় না ।
( ২ )জগতকে ‘আপতিক’ বা ‘সাপেক্ষ’ এবং ঈশ্বরকে ‘আবশ্যিক’ বা ‘নিরপেক্ষ’ রূপে গণ্য করলেও অ্যাকুইনাস সঠিক কাজ করেননি । এখানে ঈশ্বর যদি আবশ্যিক হন তাহলে ‘ঈশ্বর’ হয়ে যাবে পরিনিয়ন্ত্রিত সত্তা ।
শেষকথা : উপরের আলােচনা থেকে দেখা গেল ইকবাল অত্যন্ত জোরালাে যুক্তির দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছেন এবং ইকবাল দৃঢ়তার সাথে ঘােষণা করেছেন স্বজ্ঞা মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব ।