উত্তর : সবই অনিত্য , সবই ক্ষণিক : বৌদ্ধ মতে সবকিছুই অনিত্য , সবই ক্ষণিক( সবং অনিত্যম্,ক্ষণিকম্ ) এখানে অপরিবর্তনশীল , নিত্য,শাশ্বত কোনাে সত্তা নেই । সবই সদা পরিবর্তনশীল । এই পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যবাদের ভিত্তি হল প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ । প্রতীত্য সমুৎপাদ অনুযায়ী কার্যমাত্রই কারণকে অপেক্ষা করে উৎপন্ন বলে কারণ না থাকলে কার্যটিও থাকে না । ফলে , কার্যমাত্রই অনিত্য । বৌদ্ধ দর্শনের অনিত্যবাদ পরবর্তীকালে ক্ষণিকতাবাদে পরিণত হয় । ক্ষণিকতাবাদ অনুযায়ী সমস্ত বস্তুই ক্ষণিক অর্থাৎ একটি মাত্র ক্ষণেই উপস্থিত থাকে , বা স্থায়ী হয় ।
‘ক্ষণিক’ শব্দের অর্থ : বৌদ্ধ দার্শনিক অশ্বঘােষ প্রমুখরা পরিবর্তনবাদকে ক্ষণিকবাদে রূপান্তরিত করেন । ‘ক্ষণিক’ শব্দের অর্থ এক ক্ষণস্থায়ী ।কাজেই , ক্ষণিক বস্তুর অর্থক্ষণস্থায়ী বস্তু । কোন কোন বৌদ্ধ মতে , বস্তু যে ক্ষণে উৎপন্ন হয় পরক্ষণেই তা বিনষ্ট হয় অর্থাৎ ক্ষণিক - এর অর্থ উৎপত্তির পরক্ষণেই বিনাশ । কিন্তু অন্যান্য বৌদ্ধ মতে , ‘তৃতীয়ক্ষণ ধ্বংস প্রতিযােগিত্বই’ হল ক্ষণিকতার লক্ষণ । কাজেই , ক্ষণিকবস্তু মাত্রই প্রথম ক্ষণ উৎপত্তি দ্বিতীয়ক্ষণে স্থিতি এবং তৃতীয় ক্ষণে বিনাশ । একটি মাত্র ক্ষণে স্থায়ী হয় ক্ষণিক বলা হয় ।
সৎ বস্তুর লক্ষণ : বৌদ্ধ মতে সৎ বস্তু বা সদ্বস্তর লক্ষণ হল , “অর্থক্রিয়াকারিত্ব লক্ষণম্ সৎ ” অর্থাৎ অর্থক্রিয়াকারি বস্তুই সৎ । সৎ অর্থাৎ অস্তিত্ব আছে বা সত্তা আছে । ‘অর্থক্রিয়া’ শব্দের অর্থ কার্য উৎপাদনের সামর্থ্য বা ক্ষমতা । যে বস্তুর কার্যোৎপাদনের ক্ষমতা থাকে তাই সৎ বস্তু । আর যার কার্য উৎপাদন ক্ষমতা নেই তা সৎ নয় । এজন্য অর্থক্রিয়াকারীকেই সৎ বলা হয়েছে ।
ক্ষণিকতাবাদের পক্ষে যুক্তি : রতনকীর্তি ক্ষণিকতাবাদকে অনুমানের দ্বারা প্রমাণ করেছেন । তাঁর মতে অন্বয় ব্যতিরেকে ব্যাপ্তি দ্বারা বস্তুর ক্ষণিকত্ব প্রমাণিত হয় । তাঁর অনুমানটি হল— যা
অর্থক্রিয়াকারী তাই সৎ
যা সৎ তা ক্ষণিক
. : যা অর্থক্রিয়াকারী তাই ক্ষণিক ।
বস্তুতঃ বৌদ্ধমতে , অর্থক্রিয়াকারী বস্তুমাত্রকেই সৎ এবং সৎ মাত্রকেই ক্ষণিক বলা হয়েছে । আর যা ক্ষণিক নয় তা সৎ নয় ।
সদ্ববস্তুর অর্থক্রিয়া : সৎ বস্তুমাত্রই অর্থক্রিয়াকারী । এই অর্থক্রিয়া কোনাে বস্তুতে দু’ভাবে থাকতে পারে যুগপৎ বা একটি মাত্র ক্ষণে এবং ক্রমিক বা ধারাবাহিক । যুগপৎ অর্থক্রিয়া থাকলে কোনাে বস্তু একটি বিশেষ ব্যক্তির একবার একটি মাত্র প্রয়ােজন মেটাবে বলে বস্তুটিকে ক্ষণিক বলতে হয় । যেমন - কোনাে একটি ফল একজন ব্যক্তির একবার একটি মাত্র প্রয়ােজন মেটায় বা ক্ষুধা নিবৃত্তি করে বলে বস্তুটি ক্ষণিক বলতে হয় । আবার , অর্থক্রিয়া ক্রমিক বা ধারাবাহিক হলেও বস্তুটিকে ক্ষণিক বলতে হয় । কারণ , কোনাে বিশেষ একটি বস্তু ভিন্ন ভিন্ন ক্ষণে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ভিন্নভিন্ন প্রয়ােজন মেটাতে সক্ষম হলেও যে ক্ষণে কোনাে বিশেষ প্রয়ােজন মেটায় সেই বিশেষ ক্ষণটিতে অন্য ব্যক্তির অন্য প্রয়ােজন মেটাতে পারে না । বিশেষ বিশেষ ক্ষণে বিশেষ বিশেষ অর্থক্রিয়া থাকে একথাই মানতে হয় বলে বস্তুটিকে ক্ষণিক বলতে হয় ।
নৈয়ায়িক মতের উত্তর : স্থায়ী বস্তুরও কার্যোৎপাদন ক্ষমতা থাকে । কিন্তু সহকারী কারণ না থাকায় কার্যোৎপাদন হয় না । সহকারী কারণের সাহায্যে কার্যটি উৎপন্ন হয় । তাহলে বৌদ্ধদের যুক্তি হবে কার্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সহকারী কারণের অভাবে কার্যটি উৎপন্ন হয় না তাহলে সে ক্ষেত্রে সহকারী কারণটিই মূল কারণ হবে এবং মূল কারণটি সেখান অকারণ বা অপ্রয়ােজনীয় হয়ে পড়বে । কাজেই , অর্থক্রিয়া যুগপৎ অথবা ক্রমিক বা ধারবাহিক যাই হাে না কেন বস্তুটি শেষ পর্যন্তক্ষণিক বস্তুতেই পরিণত হয় ।
সমালােচনা : ন্যায় মতে , বৌদ্ধ ক্ষণিকতাবাদ অনবস্থা দোষ দুষ্ট । কারণ , কোনাে বস্তুর অস্তিত্বের প্রমাণ যদি তার কার্য হয় তাহলে ঐ কার্যটির সত্তা বা অস্তিত্ব আছে কি না তা জানার জন্য তার কার্যকে জানতে হয়, ফলে অনবস্থা দোষ হয় ।
মূল্যায়ণ : রতনকীর্তি নৈয়ায়িকদের মত খন্ডন করে অন্বয় ব্যতিরেক ব্যাপ্তি দ্বারা অনুমানের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন বস্তু মাত্রই ক্ষণিক । কাজেই বস্তুর ক্ষণিকতা প্রমাণের জন্য অনুমান প্রমাণই যথেষ্ট । কোনাে নিত্য দ্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকারের প্রয়ােজন নেই ।