মায়া বা অবিদ্যা সম্পর্কে শঙ্করের মত আলােচনা কর ।

অনাস পাস দর্শন honours pass general philosophy মায়া বা অবিদ্যা সম্পর্কে শঙ্করের মত আলােচনা কর maya abiddya somporke shankarer mot alochona koro questions answers


উত্তর : আচার্য শঙ্কর কেবলাদ্বৈতবাদের আলােচনায় পারমার্থিক দিক থেকে ব্রহ্মকে একমাত্র সত্য বলে ব্রহ্ম ভিন্ন যাবতীয় বিষয়কে ব্রহ্মের বিবর্তস্বরূপ মিথ্যা কার্য বলেছেন । তার মতে নির্গুণ ব্রহ্ম জগতের বিবর্ত কারণ হলেও মায়া বা অজ্ঞানই মূল উপাদান কারণ । মায়া শুদ্ধ চৈতন্যের উপাধি হলে সেই মায়া উপহিত চৈতন্যকে সাক্ষী বলে । আবার , মায়া যখন শুদ্ধ চৈতন্যের বিশেষণ হয় তখন সেই মায়াবিশিষ্ট চৈতন্যকে বলা হয় ঈশ্বর । আর অন্তঃকরণের দ্বারা অবচ্ছিন্ন বা পরিচ্ছিন্ন চৈতন্যের নাম জীব । কাজেই , জীব , ঈশ্বর , সাক্ষী সবই অজ্ঞান বা অবিদ্যাকে আশ্রয় করেই হয় । ব্যবহারিক দিক থেকে জীব , ঈশ্বর , সাক্ষী সত্য হলেও ব্রহ্ম ভিন্ন এদের পৃথক সত্তা না থাকায় ব্রহ্মের সত্তাই জীব জগতের সত্তারূপে প্রতীয়মান হয় । 

অদ্বৈত বেদান্তে শঙ্করাচায় মায়া,অবিদ্যা , অজ্ঞান , অধ্যাস প্রভৃতি শব্দগুলিকে সমার্থক রূপে আলােচনা করেছেন । শঙ্করের , মতে যে জ্ঞান পরবর্তী যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা বিনষ্ট হয় তাই অজ্ঞান বা অবিদ্যা । কোন একটি বস্তু বা বিষয়ে অভিন্ন বস্তু বা বিষয়ের প্রতীতিই অজ্ঞান বা অবিদ্যা । অর্থাৎ কোন একটি বস্তু প্রকৃতপক্ষে যা ওই বস্তুটিকে যদি তা থেকে ভিন্ন বস্তু রূপে জ্ঞান হয় তবে সেই জ্ঞানটি হবে অজ্ঞান বা অবিদ্যা । যেমন — রজুতে সর্পভ্রম স্থলে প্রকৃত বস্তুটি রজ্জু হলেও ঐ রজ্জুর পরিবর্তে সর্পের জ্ঞান হয় । অধ্যাস বা অবিদ্যার ক্ষেত্রে সর্বদাই অধিষ্ঠানটি সত্য এবং অধ্যাস্ত বিষয়টি মিথ্যা হয় । রজ্জুসৰ্প স্থলে অধিষ্ঠান স্বরূপ রজ্জুটি সত্য , আর অধ্যস্ত সপটি মিথ্যা । একই ভাবে , পারমার্থিক দিক থেকে অধিষ্ঠান স্বরূপ ব্রহ্মই সত্য এবং অধ্যস্ত জীব জগৎ মিথ্যা । 


শঙ্করের মতে , অবিদ্যা বা অধ্যাসের দু’প্রকার কার্য আছে । এই দুটি কার্যের ক্ষেত্রে দু প্রকার শক্তি স্বীকার করা হয় । যথা — ( ১ ) আবরণ শক্তি এবং ( ২ ) বিক্ষেপ শক্তি । আবরণ শক্তি কোন বস্তুর স্বরূপকে আবৃত করে । আর , বিক্ষেপ শক্তির কাজ হল অন্য বস্তুর গুণাবলী ওই বস্তুতে আরােপ করা । অজ্ঞানের ক্ষেত্রে আবরণ শক্তি দ্বারা কোন বস্তু স্বরূপ আবৃত্ত হলে বিক্ষেপ শক্তি দ্বারা ওই বস্তুতে তদ্ভিন্ন বস্তুর গুণাবলী আরােপিত হয় । ফলে , একটি বস্তু প্রকৃতপক্ষে যা তা থেকে ভিন্ন বস্তু রূপে প্রতীয়মান হয় । যেমন — রজ্জুসৰ্প স্থলে আবরণ শক্তি দ্বারা রজ্জুর গুণাবলী আবৃত হলে বিক্ষেপ শক্তি দ্বারা সর্পের গুণাবলী রজ্জুতে আরােপিত হয় এবং তার ফলেই রজ্জুতে সর্পের জ্ঞান হয় ।



শঙ্করাচার্যের মতে , এই জগৎ মায়ার সৃষ্টি । মায়া হল ঈশ্বরের শক্তি । ঈশ্বর মায়াশক্তি থেকে অভিন্ন হলেও ঈশ্বর ওই শক্তি দ্বারা প্রতারিত হয় না । কারণ , মায়া ঈশ্বরের অধীন , ঈশ্বর মায়ার অধীন নন । ব্রহ্মের দিক থেকে মায়া হল ঈশ্বরের সেই শক্তি যার দ্বারা ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন । ঈশ্বর মায়া শক্তি দ্বারা ব্রহ্মের স্বরূপকে আচ্ছন্ন করে জীবজগতের  প্রতীতিতে সাহায্য করে । 


শঙ্করের মতে , মায়া বা অবিদ্যা মিথ্যা । কারণ , মায়া সৎ , অসৎ বা অসৎ কোনটিই নয় । অজ্ঞান বা মায়া সৎ নয় । কারণ মায়া বা অজ্ঞান পরবর্তী জ্ঞানের দ্বারা বিনষ্ট হয় । আর , যা পরবর্তী জ্ঞানবিনশ্যতা সৎ হতে পারে না । মায়া বা অবিদ্যা অসৎ নয় । কারণ , অসৎ অর্থাৎ আকাশ কুসুমের ন্যায় অলীক , যার কোনাে প্রতীতি বা প্রত্যক্ষ হয় না । কিন্তু মায়া বা অবিদ্যার ক্ষেত্রে সর্পের প্রতীতি বা প্রত্যক্ষ হওয়ায় মায়া বা অবিদ্যা অসৎ নয় । আবার , সৎ ও অসৎ পরস্পর বিরুদ্ধ হওয়ায় একই সাথে কোন বিষয় সৎ ও অসৎ অর্থাৎ সদসৎ হতে পারে না বলে মায়াকে সদসৎও বলা যায় না । এজন্য , শঙ্কর মায়াকে মিথ্যা বলেছেন । 

জ্ঞানের মতাে অজ্ঞানেরও সামান্য ও বিশেষ নামে দুটি অংশ থাকে । অজ্ঞানের ক্ষেত্রে সামান্য অংশের জ্ঞান এবং বিশেষাংশের অজ্ঞান থাকে । যেমন— ‘এইটি সাপ’ – এরূপ ক্ষেত্রে ‘এইটি’ হল জ্ঞানের সামান্য অংশ । আর , সাপটি হল বিশেষ অংশ । কাজেই , অজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভ্রমের বিষয়টি সর্বদাই জ্ঞানের বিশেষ অংশেই হয় । 

অধ্যাসের ক্ষেত্রে সর্বদাই অধ্যস্ত বিষয়ের পূর্বানুভব জন্য স্মৃতি আবশ্যক । কারণ , যে ব্যক্তি কোনদিন সর্প দেখেনি সেই ব্যক্তির কখনও রজ্জুতে সর্পের ভ্রম হবে না । এছাড়া , অধ্যস্ত ও অধিষ্ঠানের মধ্যে সাদৃশ্য থাকাও আবশ্যক । কারণ , রজ্জুর সাথে সর্পের আকৃতিগত সাদৃশ্য থাকায় রজ্জুতে সর্পের ভ্রম হতে পারে । তেমনি , রজ্জুর সাথে হস্তীর সাদৃশ্য না থাকায় রজ্জুতে কখনও হস্তীর ভ্রম হতে পারে না । 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন