উত্তর : লৌকিক মত : ভারতীয়দের সাধারণ বিশ্বাস হল প্রতিটি দেহে একটি করে আত্মা থাকে , যে আত্মা দেহ থেকে ভিন্ন । কারণ , মৃত্যুর পর দেহ বিনষ্ট হলেও আত্মার বিনাশ নেই । পরবর্তীকালে অন্য দেহ ধারণ করে । অবশ্য এটিই ভারতীয়দের একমাত্র মত নয়। এর বিপরীত মতও ভারতীয়দের আলােচনায় পাওয়া যায় ।
চার্বাক দর্শন : ভারতীয় দর্শনে চার্বাক সম্প্রদায় জড়বাদী নাস্তিক দর্শন বলে পরিচিত । প্রত্যক্ষবাদী হিসাবে দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব চার্বাকগণ স্বীকার করে না । চার্বাক মতে , চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা চৈত্য দেহের আগন্তুক গুণ । তাই ,মৃত্যুর পর দেহের বিনাশের সাথে আত্মারও বিনাশ ঘটে । ফলে , মৃত্যুই মুক্তি।
জৈন দর্শন : জৈন মতে ,প্রতিটি দেহেই একটি করে আত্মা থাকে । এই আত্মা নিত্য , সগুণ , সক্রিয় ও দেহাতিরিক্ত একটি সত্তা । আত্মা চৈতন্য ধর্মবিশিষ্ট । ফলে , আত্মাই কর্ত্তা , প্রমাণ স্বীকার করে । এই দুটি প্রমাণদ্বারছি ভােক্তা ও জ্ঞাতা । জৈন দর্শন প্রত্যক্ষ ও প্রমাণ স্বীকার করে । এই দুটি প্রমাণ দ্বারাই আত্মাকে জানা যায় । জৈন মতে , প্রতিটি দেহেই একটি করে আত্মা থাকায় আত্মা এক নয় , বহু ।
বৌদ্ধদর্শন : বৌদ্ধদর্শন নাস্তিক হলেও আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে । বৌদ্ধ মতে , সবকিছুই ক্ষণিক হওয়ায় আত্মাও ক্ষণিক । আত্মা হল ক্ষণিক বিজ্ঞান সন্তান বা মানসিক প্রক্রিয়ার প্রবাহ । তারা নিত্য শাশ্বত আত্মা স্বীকার না করলেও অতীত ও পরজন্মে বিশ্বাস করে । অবিদ্যা থেকে উৎপন্ন সংস্কার দ্বারাই আত্মার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে । বৌদ্ধ মতে , আর্যসত্য চতুষ্টয় এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন দ্বারা আত্মা নির্বাণ লাভ করে এবং সমস্ত প্রকার দুঃখের চিরনিবৃত্তি লাভ করে ।
ন্যায় দর্শন : ন্যায় মতে , আত্মা এক নয় , বহু । কারণ , প্রতিটি জীবেই আত্মা বিরাজমান । ন্যায় মতে , আত্মা স্বরূপতঃ এক অচেতন দ্রব্য বিশেষ , যা দেহ ও ইন্দ্রিয়ের সাথে যুক্ত হয়ে চেতনা লাভ করে । যদিও আত্মা দেহ মন ও ইন্দ্রিয় থেকে ভিন্ন একটি দ্রব্য । এটি ভৌতিক কোন দ্রব্য নয় । চৈতন্য আত্মার ধর্ম নয় বলে দেহহীন আত্মায় চেতনা থাকে না ।
বৈশেষিক দর্শন : বৈশেষিক দর্শনে আত্মাকে এক নিত্য , সর্বব্যাপী অচেতন দ্রব্য বলা হয়েছে । আত্মা স্বরূপতঃ অচেতন হলেও দেহের সংস্পর্শে আসার পর আত্মা চৈতন্য লাভ করে । ফলে চৈতন্য হল আত্মার আগন্তুক গুণ । আত্মার চেতনা না থাকায় আত্মা নির্গুণ ও নিষ্ক্রিয় ।
সাংখ্য দর্শন : সাংখ্যদর্শনের আত্মা হল পুরুষ । পুরুষকে সাংখ্যে বহু বলা হয়েছে । কারণ , প্রতিটি জীবেই পুরুষ বা আত্মা থাকে । আত্মা বা পুরুষ নিত্য , স্বপ্ৰকাশ, নির্গণ , নিষ্ক্রিয় ও অপরিণামী , দেহ , ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি থেকে ভিন্ন ।
যােগদর্শন : যােগ দর্শন সাংখ্যের সমানতন্ত্র । যােগ দর্শনকে সেশ্বর সাংখ্যও বলা হয় । যােগ দর্শনের আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় । এই আত্মা দেহ , ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি থেকে ভিন্ন , যা নিত্য, স্বপ্ৰকাশ, নিগুন, নিষ্ক্রিয় ও অপরিণামী । যােগ দর্শনেও আত্মার বহুত্ব স্বীকৃত হয়েছে ।
মীমাংসা দর্শন : মীমাংসকগণ নিত্য ও সর্বব্যাপী আত্মীয় বিশ্বাসী । আত্মা দেহ , মন ও বুদ্ধি থেকে পৃথক একটি দ্রব্য । দেহের অবসানের পর আত্মা কর্মফল অনুযায়ী অন্য দেহ ধারণ করে । মীমাংসক মতে আত্মা এক নয়, বহু । কারণ , প্রতিটি দেহেই ভিন্ন ভিন্ন আত্মা থাকে । প্রভাকর মীমাংসক মতে , আত্মা নিগুর্ণ ও নিষ্ক্রিয় এবং অচেতন । তার মতে , আত্মা মনের সাথে , মন ইন্দ্রিয়ের সাথে , ইন্দ্রিয় দেহের সাথে যুক্ত হলে চৈতন্যরূপ গুণের আবির্ভাব ঘটে । কাজেই , চৈতন্য বা চেতনা হল আত্মার আগন্তুক গুণ ।
বেদান্ত দর্শন : বেদান্ত মতে , আত্মা এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন । ফলে , আত্মাও এক অদ্বিতীয় । শঙ্কর বেদান্তে ব্যবহারিক দৃষ্টিতে আত্মা বা জীবের বহুত্ব স্বীকার করা হলেও পারমার্থিক দৃষ্টিতে জীব বা আত্মা এক ও অদ্বিতীয় । কারণ , আত্মা বা জীবই ব্রহ্ম— এটাই অদ্বৈত বেদান্তের মত । রামানুজ বিশিষ্ট্যা দ্বৈতবাদে আত্মা বা জীবকে ব্রহ্মের চিৎ অংশ বলেছেন । এই আত্মা সক্রিয় , সগুণ ও সচেতন হলেও দেহ , মন ,প্রাণ , ইন্দ্রিয় থেকে স্বতন্ত্র ।
মূল্যায়ণ : ভারতীয় দর্শনের প্রতিটি আস্তিক এবং নাস্তিক সম্প্রদায়ই আত্মার অস্তিত্বকে মেনেছেন । যদিও আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে মতভেদ স্পষ্ট ।