উত্তর : আত্মা সম্পর্কে চার্বাক মত : চার্বাকগণ প্রত্যক্ষবাদী হিসাবে দেহাতিরিক্ত আত্মার কোন অস্তিত্ব স্বীকার করে না । চার্বাক মতে , দেহই আত্মা । অবশ্য ,দেহে চৈতন্য বা চেতনা থাকে সেই দেহই আত্মা । চার্বাক মতে , ”চৈতন্যবিশিষ্ট দেহ এর আত্মা” — অর্থাৎ চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা ।চার্বাকদের এই মতকেই দেহাত্মবাদ বলা হয় ।
দেহাত্মবাদের অর্থ : দেহাত্মবাদের অর্থ দেহই আত্মা । ফলে , যতক্ষণ দেহ থাকে ততক্ষণই আত্মার অস্তিত্ব থাকে । আবার , দেহের বিনাশের মধ্য দিয়ে আত্মারও বিনাশ ঘটে । চার্বাকগণ যে দেহকে আত্মা বলেছেন তা হল চৈতন্যবিশিষ্ট দেহ । মৃত ব্যক্তির দেহ থাকলেও সেই দেহকে চার্বাকগণ আত্মা বলেননি ।এজন্য , চার্বাক মতে চেতনাবিশিষ্ট দেহ অর্থে দেহকে ব্যাখ্যা করায় দেহাত্মবাদের অর্থ করা হয়েছে দেহ - ই আত্মা ।
চৈতন্য দেহেরই গুণ : চার্বাকগণ জড়বাদী হিসাবে জড় ভূতচারটিকেই যাবতীয় সৃষ্টির মূল উপাদান বলে মেনেছেন । আমরা সাধারণত আত্মাকে অজড় বলে মনে করি কিন্তু চার্বাক মতে সবই জড় উপাদান দ্বারা সৃষ্টি । চৈতন্য বা চেতনাকে অজড় বলা হলেও চার্বাক মতে , চৈতন্য বা চেতনাও জড় ভূতের সমন্বয়ে গঠিত । চার্বাক মতে চৈতন্য বা চেতনা হল একটি আগন্তুক গুণ । ক্ষিতি, অপ , তেজ ও মরুৎ এই চারটি ভূতের কোনটিতেই চেতনা বা চৈতন্য থাকে না । কিন্তু এই জড় ভূত চারটির নির্দিষ্ট পরিমাণ মিশ্রণের মধ্য দিয়ে চৈতন্য নামক নতুন একটি গুণের আবির্ভাব ঘটে । জড়ভূত থেকে চৈতন্য বা চেতনার এই ব্যাখ্যাকে ভূতচৈতন্যবাদ বলে । চার্বাকমতে , জড় ভূতের দ্বারা চৈতন্যের সৃষ্টি হয় বলে দেহের বিনাশের পর চৈতন্যও থাকে না । কাজেই , চার্বাকমতে , দেহের বিনাশের সাথে আত্মারও বিনাশ ঘটে । অর্থাৎ দেহাতিরিক্ত আত্মার কোনাে অস্তিত্ব নেই ।
দেহাত্মবাদের পক্ষে যুক্তি : চার্বাক মতে , দেহই আত্মা , চার্বাকগণ তাদের এই মতের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছেন , ‘আমি স্থূল’ ‘আমি কৃশ’ ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘আমি’ দ্বারা আমরা যে আত্মার কথা বলি স্থূলতা, কৃশতা ইত্যাদি সেই আত্মারই গুণ । স্থূল, কৃশ ইত্যাদি গুণগুলি দেহেরই গুণ বলে দেহ - ই আত্মা — এই মতই প্রতিষ্ঠিত হয় ।
জড়ভূত থেকে অজড় চৈতন্যের আবির্ভাব : চার্বাক মতে , ক্ষিতি, অপ ,তেজ এবং মরুৎ এই চারটি ভূতই জড় এবং এদের কোনটির মধ্যেই চেতনা থাকে না ।অথচ , এদের মিশ্রণের মধ্য দিয়ে অজড় চৈতন্যের আবির্ভাব কিভাবে হয় তার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে , চুন , পান , খয়ের এবং সুপারি এই চারটি কোনটিই রক্তবর্ণের নয় । অথচ এই চারটির মিশ্রণের মধ্য দিয়ে যেমন রক্ত বর্ণের আবির্ভাব ঘটে তেমনি ক্ষিতি, অপ , তেজ ও মরুৎ ভূত চারটি জড় হলেও এদের নির্দিষ্ট পরিমাণ মিশ্রণের মধ্য দিয়ে অজড় চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটে । চার্বাকদের এই মতবাদ ভূতচৈতন্যবাদ নামে পরিচিত ।
চার্বাক দর্শনের শ্রেণি : চার্বাক দার্শনিকদের মধ্যে তিনটি ভাগ লক্ষ্য করা যায় । যথা— আদি বা ধূর্ত চার্বাক, বৈতাণ্ডিক চার্বাক এবং সুশিক্ষিত চার্বাক । আদি বা ধূর্ত চার্বাকরাই মূলত দেহাত্মবাদ প্রচার করেছেন । এদের মতে দেহ এবং আত্মা অভিন্ন । সুশিক্ষিত চার্বাগগণ দেহ থেকে স্বতন্ত্র আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও তারা দেহকে আত্মা বলেননি ।
আত্মা সম্পর্কে সুশিক্ষিত চার্বাক মত : পরবর্তীকালে যে সমস্ত চার্বাক আদি চার্বাকদের তত্ত্বের কিছু কিছু সংখ্যক সাধন করেছেন তারাই সুশিক্ষিত চার্বাক । সুশিক্ষিত চার্বাকরা দেহাতিরিক্ত আত্মার স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকার না করলেও তাদের কেউ বা ইন্দ্রিয়কে, কেউবা মনকে , আবার কেউবা প্রাণকে আত্মা বলেছেন । কাজেই , আত্মা সম্পর্কে তিনটি মত পাওয়া যায় । যথা - ইন্দ্রিয়াত্মবাদ,মনাত্মবাদ এবং প্রাণাত্মবাদ । যারা ইন্দ্রিয়কে আত্মা বলেছেন তাদের মতকে ইন্দ্রিয়াত্মবাদ যারা মনকে আত্মা বলেছেন তাদের মতকে মনাত্মবাদ এবং যারা প্রাণকে আত্মা বলেছেন তাদের মতকে প্রাণাত্মবাদ বলা হয় ।অবশ্য , ইন্দ্রিয়, মন ও প্রাণ এই তিনটিই দেহে আশ্রিত এবং দেহাতিরিক্ত কোন অস্তিত্ব না থাকায় চার্বাকদের আত্মা সম্পর্কীয় মতকে দেহাত্মবাদ বলা হয় ।
সমালােচনা : চার্বাকদের দেহাত্মবাদের সমালােচনায় নৈয়ায়িকগণ বলেছেন চৈতন্য দেহের গুণ হলে যতক্ষণ দেহ থাকবে ততক্ষণই চৈতন্য থাকার কথা । কিন্তু প্রাণহীন দেহে বা মৃত ব্যক্তির দেহ থাকলেও সেই দেহে চেতনা থাকে না । আত্মা দেহের গুণ হলে দেহের পরিবর্তনে আত্মারও পরিবর্তন মানতে হয় ।ফলে , শৈশবের দেহ ও বার্ধক্যের দেহের পরিবর্তন থেকে আত্মার পরিবর্তনও মানতে হয় । কিন্তু, আমরা বিশ্বাস করি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একই আত্মা বিভিন্ন সময়ে দেহে থাকে । ফলে দেহই এই মত ঠিক নয় । তাছাড়া , দেহের পরিবর্তনের ফলে যদি আত্মারও পরিবর্তন ঘটত তাহলে স্মৃতি অসম্ভব হতাে । বেদান্তে চার্বাকদের দেহাত্মবাদ খন্ডনে বলা হয়েছে চৈতন্যদেহের গুণ হলে মূৰ্ছা বা সুষুপ্তির অবস্থাতেও দেহে চেতনা থাকত । কিন্তু মূৰ্ছা ও সুষুপ্তির অবস্থায় দেহ থাকলেও চৈতন্য থাকে না ।
মূল্যায়ণ : চার্বাকগণ জড়বাদী হিসাবে জড় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আত্মার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সর্বতােভাবে গ্রহণযােগ্য না হলেও তারা আত্মা নামক অজড় তত্ত্বেরযে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য ।