উত্তর : পতঞ্জলি যােগ এবং সমাধি শব্দ দুটিকে সমার্থক বলে যােগের লক্ষণ করেছেন, যােগঃ চিত্তবৃত্তি নিরােধঃ অর্থাৎ চিত্ত বৃত্তির নিরােধই যােগ । তৎসত্ত্বেও তিনি সমাধির আলােচনায় পৃথক সমাধির লক্ষণ দিয়েছেন । সমাধির এই লক্ষণটি হল— তদেবার্থাত্ৰানির্ভাসং স্বরূপ শূন্যমিব সমাধিঃ — অর্থাৎ যখন ধ্যানের বস্তুর আকৃতি ও বাহ্যরূপ পরিত্যক্ত হয় এবং কেবল অর্থ মাত্র প্রকাশিত হয় তখন তাকে সমাধি বলে ।
যােগ দর্শনে যােগ বা সমাধিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে । যথা – (১ )সম্প্রজ্ঞাত সমাধি এবং ( ২ ) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি ।
সম্প্রজ্ঞাত সমাধি : অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তি নিরুদ্ধ হলে প্রথমে যে যােগ বা সমাধি হয় তাই সম্প্রজ্ঞাত যােগ বা সমাধি । এই অবস্থায় চিত্ত একটি বিষয়ে নিবিষ্ট হয় এবং ঐ বিষয়ের সম্যক জ্ঞান হয় । এই অবস্থাকেই মজ্ঞাত সমাধি বলে । সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে চিত্ত বৃত্তিঅবলুপ্তি ঘটে না । যেহেতু বিষয়বীজ থেকে যায় । সেজন্য সম্প্রজ্ঞাত সমাধিকে সবীজ সমাধিও বলা হয় ।
সম্প্রজ্ঞাত সমাধি আবার চার প্রকার । যথা – সবিতর্ক , সবিচার , সানন্দ, এবং সাম্মিত । এই চারটি অবস্থাতেই ধ্যানের বিষয়টির প্রতি একাগ্রচিত্ত ছাড়া অন্য সমস্ত বৃত্তিগুলিই নিরুদ্ধ হয় । আর , সমস্ত বৃত্তি নিরুদ্ধ হলে তাকেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলে ।
‘সবিতর্ক’ সমাধির ‘বিতর্ক’ বলতে বােঝায় ধ্যানের বিষয়টির সাক্ষাৎকারাত্মক জ্ঞান । এই অবস্থায় দেব বা দেবীর স্থূল মূর্তিতে চিত্ত নিবিষ্ট হয় এবং ঐ মূর্তির সাক্ষাৎকার হয় । সবিতর্ক সমাধিতে স্থূল বস্তুর বিশেষরূপে জ্ঞান হয় , এবং বিষয় বিষয়ীর দ্বৈত ভাব থাকে ।
সবিচার সমাধিতে স্থূল বস্তু থেকে তার কারণস্বরূপ সূক্ষ্ম বিষয়ের ধ্যান হয় । এই সমাধিতে ধ্যানের বিষয়টির যে সূক্ষ্ম কারণ প্রকৃতি , মহত্তত্ত্ব , অহঙ্কার , পঞ্চতন্মাত্র প্রভৃতির সাক্ষাৎ করা হয় । এটি সবিতর্ক সমাধির তুলনায় উন্নত তর । দেশ কালে অবচ্ছিন্ন বা সীমিতরূপে তন্মাত্র প্রভৃতির যে সূক্ষ্ম কারণের ভাবনা তাই সবিচার সমাধি । আর , দেশ কালের দ্বারা নিরবচ্ছিন্নভাবে সূক্ষ্মতত্ত্বের যে সাক্ষাৎকার তাই নির্বিচার সমাধি ।
সানন্দ সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে ইন্দ্রিয়সমূহই ধ্যানের বিষয় হয় । এই স্তরে যােগীর সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ হয় । ফলে , যােগীর চিত্তে আনন্দ উৎপন্ন হয় । আনন্দের সাক্ষাৎকার হওয়ায় এই সমাধিকে সানন্দ সমাধি বলা হয় ।
সাম্মিত সম্প্রজ্ঞাত সমাধির ধ্যানের বিষয় হল ইন্দ্রিয় সমূহের কারণ অস্মিতা বা সাত্ত্বিক অহঙ্কার । এই অবস্থায় অন্তঃকরণে রজঃ ও তমােগুণশূন্য কেবল সাত্ত্বিক গুণের চিন্তা হয় । এবং পুরুষের একীভূত করে জ্ঞান হয় । অর্থাৎ চি ত্তসত্ত্বপ্রধান হওয়ায় অহঙ্কারকে পুরুষ বলে ভ্রম হয় । একেই সাম্মিত সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলে । এটিই সম্প্রজ্ঞাত সমাধির শেষ স্তর ।
অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি দু’প্রকার — ভবপ্রত্যয় এবং উপায় প্রত্যয় । ভবপ্রত্যয় অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি নিকৃষ্ট মানের । কারণ , এই সমাধিতে বৈকল্য বা মুক্তি হয় না । এটি জন্মের কারণ । এজন্য উপায় , প্রত্যয় অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিকেই মুখ্য ও কৈবল্যের হেতু বলা হয়েছে । শ্রদ্ধা, বীর্য ,স্মৃতি, সমাধি ,প্রজ্ঞা সবকিছুতে বৈরাগ্য আসে । এরূপ বৈরাগ্যের ফলেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয় । প্রকৃত যােগীরা এই সমাধিই লাভ করেন ।
কৈবল্য লাভই যােগ সাধনার চরম লক্ষ্য । সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে পুরুষ সাক্ষাৎকার বা বিবেক খ্যাতি উৎপন্ন হলে যােগী জীবিত কালে জীবন্মুক্ত হয় এবং জীবন্মুক্ত যােগীর দেহাবসানের পর যে কৈবল্য লাভ করে তাই পরামুক্তি । বিজ্ঞান ভিক্ষু বলেছেন , কৈবল্যহেতু যে চিত্তবৃত্তির নিরােধ তাই যােগ ।